প্রাণীর ওপর নৃশংসতা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে

শাহজাহান আকন্দ শুভ
০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৮
শেয়ার :
প্রাণীর ওপর নৃশংসতা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে

কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল কিংবা ঘোড়ার মতো মানুষের সহচর প্রাণীগুলো প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আবার মানুষের নির্যাতন-হত্যার শিকার থেকে রক্ষা পাচ্ছে না বন্যপ্রাণীও। সামাজিক মাধ্যমে প্রায়ই পোষা প্রাণীর ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। আইন থাকলেও তা কার্যকর প্রয়োগের অভাবে প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর নির্যাতন যেন নিঃশব্দে ঘটে চলেছে। সমাজের অধিকাংশ মানুষ প্রাণীর প্রতি নির্যাতনকে ‘তুচ্ছ’ বিষয় হিসেবে মনে করেন। আর এতেই সমাজে প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা বাড়ছে।

প্রাণী অধিকারকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের সমাজে প্রাণীকে এখনও ‘বস্তু’ হিসেবে দেখা হয়, জীব হিসেবে নয়। এমন সামাজিক মানসিকতা প্রাণী নির্যাতনকে স্বাভাবিক করে তুলছে। যেসব শিশু ছোটবেলা থেকে প্রাণীর প্রতি সহানুভূতি শেখে না, বড় হয়ে তারাই এই নিষ্ঠুরতার ধারক হয়ে ওঠে। এই মানসিকতা না বদলালে আইনের কার্যকারিতা সীমিতই থেকে যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ কেবল নৈতিক নয়, মনোবৈজ্ঞানিক সমস্যাও তৈরি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রাণীকে নির্যাতন করে, পরবর্তী সময় তাদের মধ্যে সহিংসতা ও অপরাধ প্রবণতা বাড়ে। বন্যপ্রাণী বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ডটিম-এর প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ধর্মীয়, সামাজিক এবং পারিবারিক মূল্যবোধ অনুযায়ী কোনো প্রাণীর সঙ্গে নির্দয় আচরণ করা যাবে না। পশ্চিমা বিশে^ যারা কুকুর বিড়াল পালে তাদের ভদ্রলোক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই দৃষ্টিভঙ্গির চরম ঘাটতি রয়েছে। জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় প্রতিটি প্রাণীর সঙ্গে আমাদের সহমর্মী আচরণ করতে হবে। তিনি বলেন, প্রাণীর সুরক্ষা মানে শুধু মানবিকতা নয়, এটি পরিবেশ রক্ষারও অংশ। কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণী ময়লা পরিষ্কারে প্রাকৃতিক ভূমিকা রাখে।

বগুড়ার আদমদীঘিতে ঘরে ঢুকে মাছ খাওয়ায় বঁটি দিয়ে গলা কেটে একটি বিড়াল হত্যার অভিযোগে বুলবুলি বেগম (২৬) নামে এক নারীকে গত শুক্রবার গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাকে আদালতে সোপর্দ করা হলে বিচারক জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণ করেন।

অভিযুক্ত বুলবুলি বেগম বিড়ালটির নাড়িভুড়ি বের করে আগুনে পুড়িয়ে উল্লাস করেন। এ ঘটনা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নজরে এলে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি ওই নারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনকে নির্দেশ দেন। পরে সংগঠনটির পক্ষ থেকে গত বুধবার আদমদীঘি থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়। এরপরই পুলিশ বিড়ালের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকায় পাঠায়।

সম্প্রতি কুকুর ও বিড়ালের ওপর নিষ্ঠুরতা চালানোর ঘটনা বেড়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক আদনান আজাদ। তিনি বলেন, একটু খাবার খেতে অনেক সময় রাস্তার পাশের চায়ের দোকানের সামনে কুকুর অপেক্ষা করে। কিন্তু তাদের গরম পানি দিয়ে ঝলসে দেওয়ারও ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা এ রকম বেশ কয়েকটি কুকুরকে উদ্ধার করে চিকিৎসা দিয়েছে। তিনি বলেন, যারা প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করছে তারাই এক সময় মানুষের সঙ্গে একই আচরণ করবে। অনেক সিরিয়াল কিলারের হিস্টোরিতে এ তথ্য রয়েছে।

জবাবদিহির অভাবে সমাজে প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা বাড়ছে বলে মনে করেন পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান স্থপতি রাকিবুল হক এমিল। তিনি বলেন, নিষ্ঠুরতা আগের চেয়ে বেড়েছে না কমেছে তা জরিপ ছাড়া বলা মুশকিল। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে এ ধরনের ঘটনাগুলো এখন আমাদের নজরে আসছে। অনেক সময় মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্বের কারণে অবলা প্রাণী নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট ভাইরাল করতেও প্রাণীর ওপর নির্যাতন করে সেই ভিডিও ছাড়া হচ্ছে। কিন্তু যারা নির্যাতন করছে তারা সবসময় জবাবদিহির বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে নিষ্ঠুর আচরণ কমছে না। আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। রাষ্ট্র এ ব্যাপারে এগিয়ে আসছে না। রাষ্ট্রকে এর দায় নিতে হবে। আইন প্রয়োগ করতে হবে।

গত ২৮ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত রাজধানীর ধানমন্ডি তাকওয়া মসজিদের লেকের পাড়ে ৪টি বিড়াল পাওয়া যায়। যাদের চোখ উপড়ে এখানে ফেলে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ধানমন্ডি স্থানীয় প্রাণীপ্রেমীদের পক্ষ থেকে ধানমন্ডি থানায় লিখিত অভিযোগ করা হলে পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত এই নৃশংস অমানবিক আচরণের সঙ্গে জড়িত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

গত ১৪ অক্টোবর রাতে ময়মনসিংহের ত্রিশালে বৈলর নামাপাড়া এলাকায় হরমুজ আলীর অন্তঃসত্ত্বা গাভীর জিহ্বা কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। পরে গোয়ালঘরে বালতির ভেতর জিহ্বার কাটা অংশ পাওয়া যায়। এ ঘটনার বেশকিছু দিন অবলা এই প্রাণী খাবার মুখে নিতে পারেনি। পরে চিকিৎসার মাধ্যমে সে সুস্থ হয়ে ওঠে। এখন খাবার খেতে পারছে না। কিন্তু কে এই নিষ্ঠুর আচরণ করল, কেন করল তা জানা যায়নি।

রাজবাড়ীতে ছাগলের প্রতি নিষ্ঠুরতার নজিরও দেখা গেছে। গত ২৮ জুন রাতে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের কোর্চাডাঙ্গী গ্রামের জাহিদ মণ্ডলের বাড়ির গোয়ালঘরে ঢুকে দুর্বৃত্তরা একটি ছাগলের মাথা কেটে ফেলে। এ ছাড়া দুটি ছাগলের ঘাড় ভেঙে হত্যা করা হয়। পরে জাহিদ মণ্ডলের বাড়ির পশ্চিম পাশে মৃত ৩টি ছাগল পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে ২০১৯ সালে প্রাণী কল্যাণ আইন অনুযায়ী, প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে।

প্রাণী কল্যাণ সংগঠনগুলো প্রাণী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে দ্রুত, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, স্কুল-কলেজে প্রাণী কল্যাণ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত এবং স্থানীয় সরকার পর্যায়ে প্রাণী কল্যাণ কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছে।

শুধু গৃহপালিত নয়, বন্যপ্রাণীর সঙ্গেও মানুষ নিষ্ঠুর আচরণ করছে। প্রায়ই বন্যপ্রাণীর ওপর মানুষের নিষ্ঠুরতার খবর পাওয়া যায়। গত ২৭ অক্টোবর রাতে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ঝলই শালশিরি ইউনিয়নের কালিয়াগঞ্জে মহাবিপন্ন প্রাণী একটি বনরুইকে গুরুতর আহত করা হয়। ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ টিমের প্রতিষ্ঠাতা সহিদুল ইসলাম সেখানে গিয়ে প্রাণীটি বনরুই শনাক্ত করে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। পরে সুস্থ হয়ে ওঠে এই প্রাণীটি।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অনেক বাংলাদেশি পরিবারে পথের বিড়াল-কুকুরকে বাড়তি উপদ্রব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনকি অনেক বাবা-মা আছেন যারা রাস্তার কুকুক-বিড়ালদের লাঠি বা পাথর দিয়ে আঘাত করে তাড়িয়ে দিতে সন্তানদের উৎসাহ দেন। যার ফলে এই শিশুরা পশুদের বিষয়ে যত্নশীল না হয়েই বেড়ে ওঠে এবং নিষ্ঠুরতা তাদের চরিত্রের মধ্যে গেঁথে যায়।