বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ধীরগতি

লুৎফর রহমান কাকন
০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৮
শেয়ার :
বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ধীরগতি

অন্তর্বর্তী সরকারের ১৫ মাস পার হতে চলল। এ সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে নেমে এসেছে এক ধরনের স্থবিরতা। নতুন কোনো প্রকল্পের অনুমোদন, নতুন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, অর্থ ছাড় ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ধীরগতি ও জটিলতায় এই স্থরিবতা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, নীতিনির্ধারক মহলে অনিশ্চয়তা ও সিদ্ধান্তহীনতার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমন্বয়হীনতাও বিরাজ করছে, যার প্রভাব পড়ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে।

বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতের ৫টি কোম্পানির ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা হয় আমাদের সময়ের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, অনেকটা রুটিন ওয়ার্ক বা নিয়মিত অফিস পরিচালনা করার মতো কাজ হচ্ছে। অনেক প্রকল্পের অর্থ কাটছাঁট হয়েছে। নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এমনকি বোর্ড সভাগুলোতে নিয়মিত বাস্তবায়নযোগ্য অনেক প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে বোর্ড চেয়ারম্যানরা ধীরগতি গ্রহণ করেছেন।

ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, কোম্পানিগুলো মূলত মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। রাজনৈতিক সরকারের সময় মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে সিদ্ধান্ত আসে। সেগুলো সচিব পর্যায় থেকে নির্দেশনা পেলে বাস্তবায়ন করা হয়। এখন উপদেষ্টার কাছ থেকে নির্দেশনা না এলে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না বোর্ড চেয়ারম্যান বা মন্ত্রণালয়ের সচিবরা।

বিদ্যুৎ খাতের একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, নতুন পরিস্থিতিতে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ বদলি বা নিয়োগও ভেবে-চিন্তে করতে হচ্ছে। এমনকি বিদ্যুৎ খাতের অনেকগুলো কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করতেও দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে। জ¦ালানি খাতের কয়েকজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এমন অনেক ইস্যু আছে যেগুলোর সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা মূলত সচিবদের। কিন্তু এখন সচিবরা সেগুলো দিচ্ছেন না। তারা উপদেষ্টার দিকে তাকিয়ে থাকছেন। বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি উপদেষ্টা আবার একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকায় সহজে কোনো কিছুর অনুমোদন মিলছে না।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক মাসে বড় কোনো অবকাঠামো প্রকল্পে অগ্রগতি হয়নি। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, গ্যাস অনুসন্ধান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ ইত্যাদি সবখানেই দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও অপেক্ষা করছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতার জন্য। এ সময় আগের সরকারের পরিকল্পনাধীন অনেক প্রকল্প কাটছাঁট করে সেগুলোরই কিছু কিছু এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কাজ করছে।

যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ পর্যালোচনা। আগের সরকারের সময় ঘটে যাওয়া অনিয়ম খতিয়ে দেখা। বিশেষ করে ট্যারিফ পর্যালোচনা করে যদি সেটা যৌক্তিক পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে বিদ্যুতের দাম কিছুটা কম হবে। আর নবায়নযোগ্য জ¦ালানিতে জোর দেওয়া হয়েছে। সেগুলো নিয়ে কাজ চলছে।

বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রাবাংলা) একজন কর্মকর্তা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের পরিকল্পনাধীন নতুন কিছু কূপ খননে জোর দিয়েছে। এ ছাড়া বিশেষ আইনের অনেক প্রকল্প পর্যালোচনা করছে। সবক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর জোর দিচ্ছে। তবে সামগ্রিকভাবে প্রায় প্রত্যেক কর্মকর্তাই শঙ্কার মধ্যে আছেন। কারণ ওপরের দিকের নির্দেশনা ছাড়া নিজ উদ্যোগে কোনো কিছু করতে গিয়ে বিপদে পড়তে চান না কেউই। ফলে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। অনেক কিছু আছে চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা জিএম পর্যায় থেকেও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তবে সবাই এখন তাকিয়ে আছে মন্ত্রণালয় থেকে কী নির্দেশনা আসে।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দায়িত্বের প্রশ্নে অনেকেই সতর্ক থাকেন। ফলে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়, যা খাতটির উন্নয়ন অনেক ক্ষেত্রে ব্যাহত করে। তবে আমরা আশা করেছিলাম- এই সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতে সংস্কার বা যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। বাস্তবে সেটা দেখছি না।

এদিকে বিদ্যুৎ সরবরাহের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সরকারকে প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। গ্যাসের সংকট কমাতে পুরনো প্রক্রিয়াই বহাল রাখতে হয়েছে। বেশি করে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অন্যদিকে বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনা পরিশোধে অগ্রগতি দেখালেও দেশীয় বিদ্যুৎ কোম্পানির বকেয়া বাড়ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের একজন বলেন, আগে তাঁদের পাওনা তিন মাসের মতো বকেয়া থাকত। এখন সেটা বেড়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই স্থবিরতা দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশের শিল্পোৎপাদন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষতি হতে পারে। তাঁরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত খাতটিতে অন্তত নীতিগত দিকনির্দেশনা ও জরুরি প্রকল্পগুলোর কাজ অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নেওয়া। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। শিল্পোৎপাদন, কৃষি, সেবা, রপ্তানি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ অপরিহার্য।