শ্যামনগরে বাঘ-বিধবাদের সংকটময় জীবন

শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) সংবাদদাতা
০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৫
শেয়ার :
শ্যামনগরে বাঘ-বিধবাদের  সংকটময় জীবন

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার শেষ প্রান্তে সুন্দরবনের কোলঘেঁষে অবস্থিত গাবুরা ইউনিয়ন। চার পাশে নদীবেষ্টিত দ্বীপ ইউনিয়নটি। এর মধ্যে ৯ নম্বর সোরা গ্রামে বাস করেন হাজার খানেক মৎস্যজীবী। দিন আনা দিন খাওয়া এসব মানুষ প্রায় সবাই বাস করে সরকারি খাস জমিতে। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাঁরা বাস করেন মাটির ঘরে। আর জীবিকা নির্বাহ করে নদী-নালায় মাছ ধরে। সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে অনেকেই আর ফিরে আসেন না। বাঘের থাবায় প্রাণ হারান তাঁরা। কিন্তু তারপরও যেতে হয় সংসার নির্বাহের তাগিদে মাছ ধরতে। তাঁদের স্ত্রীদের কপালে জোটে অকাল বৈধব্য।

গাবুরা ইউনিয়নে তিন শতাধিকের বেশি বাঘ বিধবা রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন নূরনাহার। নুরনাহার ও আর কিছু বিধবার দুঃখের কথা উল্লেখযোগ্য। নূরনাহারের স্বামীকে বাঘে খাওয়া দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েক বছর। ছিপছিপে গড়নের মাত্র ২২ বছরের নূরনাহারের কোলে দুটি সন্তান। স্বামীকে হারিয়ে চোখে তিনি সরিষার ফুল দেখেন। কী করে তাঁর বাকি জীবন কাটবে। অলুক্ষণে বউ হিসেবে তাঁর কপালে অপবাদ জোটে। শুরু হয় গঞ্জনা। অসহায় জীবন কাটছে তাঁর। তাই নিজে বেছে নেন জীবন সংগ্রামের পথ। রাস্তায় মাটি কাটা, নদীতে জাল টেনে কোনো রকম তিনজনের দুই বেলা আধাপেটা খাবার জোটে। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, উল্ল­াস নূরনাহার হারিয়ে ফেলেছেন।

বিধবা নূরনাহারের মতোই বাঘে খাওয়া স্বামী হারানো বধূরা একই ধরনের বোধহীনতার মধ্যে জীবন্মৃত অবস্থায় আছে। আরেকটি বাঘ বিধবা গ্রাম ৯ নম্বর সোরা। এই গ্রামে প্রায় ২০০ লোককে বাঘে খেয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের সুন্দরবনের কোলঘেঁষা উপজেলার সদর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার ৯ নম্বর সোরা গ্রাম। গ্রামবাসীর জীবিকা নির্বাহ হয় মাছ ধরে। সংলগ্ন নদী ও সুন্দরবনে এরা মাছ ধরেন। বাস করেন সরকারি বেড়িবাঁধের ওপর ও নদীর চরে খাস জমিতে। গরিবের জন্য উন্মুক্ত জলাশয় বা বনাঞ্চলে মাছ ধরা আজকাল বেশ কঠিন। নূরনাহার বলেন শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়নি ঠিকই কিন্তু তীব্র অভাবের মধ্যে তাঁকে দিন কাটাতে হচ্ছে। স্বামী শহর আলী আমাবস্যা বা পূর্ণিমার আগে বা পরে কয়েক দিন সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরতে যেতেন। এমনি একদিন তাঁর জীবনের বড় দুর্ঘটনাটি ঘটল। একদিন তাঁর স্বামীর বাঘে খাওয়া ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে সবাই বাড়িতে ফিরে আসে।

নূরনাহারের মতো স্বামীহারা মরি বেওয়ার স্বামী মহর আলী গাজী, জসিমন নেছার স্বামী কালাচাঁদ গাজী। পাগলী খাতুনের স্বামী তছির আলী, সরবানুর স্বামী মুজিবরসহ অনেকে। পানিতে কুমির ও ডাঙ্গায় বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন পল্লীর জেলে বাওয়ালি ও মৌয়ালরা। তাঁদের অনেকের নেই টাকা পয়সা, নেই নৌকা ও জাল। মহাজনের কাছ থেকে নৌকা ও জাল নিয়ে তাঁদের যেতে হয় সাগরসংলগ্ন সুন্দরবনের নদ-নদীতে। হাড়ভাঙা খাটুনির আয়ের সিংহভাগ চলে যায় জাল ও নৌকার মালিকের হাতে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটান জেলে পল্লীর মানুষ, আর তাঁদের সন্তানদের কপালে জোটেনি লেখাপড়া।

স্বামীহারা সরবানু আক্ষেপ করে বলেনÑ ২৫ মে ২০০৯ সালের আইলার পর থেকে সরকারি-বেসরকারিভাবে অনেকগুলো ঘর গাবুরা ইউনিয়নে দুস্থদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুস্থদের না দিয়ে এলাকার চেয়ারম্যান ও মেম্বররা ৩০ হতে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে বড় লোকদের দিয়েছে। তদন্ত করলে প্রমাণিত হবে। বাঘের থাবায় স্বামী হারানো বিধবারা কোথায় যাবেন। বাঘে খাওয়া স্বামীদের আর্থিক সাহায্য পেতে স্ত্রী ও সন্তানরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিদারুল ইসলাম বলেন, আমি কয়েক দিন হচ্ছে শ্যামনগর উপজেলায় যোগদান করেছি, তবে বাঘ বিধবাদের তথ্য নিয়ে পর্যায় ক্রমে তাঁদের আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।