জুলাই স্মৃতি জাদুঘর বাদ দিয়ে স্কুল
আরডিএ কমপ্লেক্স ভবন
বিদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান লায়ন খায়রুল বাশারের বিরুদ্ধে ৩শরও বেশি মামলা রয়েছে। গত জুলাইয়ে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে তিনি কারাগারে। অথচ থেমে নেই তাঁর ব্যবসা। ইতোমধ্যে তিনি রাজশাহীতে ক্যামব্রিয়ান স্কুলের ফ্র্যাঞ্চাইজি বিক্রি করেছেন। অনুমোদন ছাড়াই সেই স্কুলের শিক্ষক নিয়োগও শুরু হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তথ্য গোপন করে আরডিএর নবনির্মিত ভবন ভাড়া নিয়ে ক্যামব্রিয়ান স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, ৬৩ কোটি টাকা খরচে নির্মিত এই কমপ্লেক্সে জুলাই স্মৃতি জাদুঘর হওয়ার কথা ছিল। তা না করে ভবনটির মালিক রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-আরডিএ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে জুলাইয়ের চেতনাবিরোধী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়েছে।
জানা গেছে, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ বজলুর রহমান আরডিএর চেয়ারম্যান থাকাকালে শুধু শেখ হাসিনাকে খুশি করতে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বঙ্গবন্ধু স্কয়ার’ নির্মাণ প্রকল্প নেন তিনি। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রায় ৬৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে কেবল ভবন নির্মাণে। এরপর আরডিএ দ্বিতীয় ধাপে বাকি টাকা চেয়েছিল। নগরীর তালাইমারি মোড়ে ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার নির্মাণ প্রকল্প নেয় আরডিএ। প্রথম দফায় ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন এবং অবকাঠামো নির্মাণ খাতে ব্যয় ধরা হয় ৬২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। মূল ভবন নির্মাণের কাজ পায় ঢাকার দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড আর্কিটেকটস্ লিমিটেড নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
আরডিএর সূত্রমতে, ২০১৮ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন হয় একনেকে। অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এই প্রকল্পের জন্য খরচ ধরা হয়েছিল প্রথমে ৫৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা। পরে সেটি বাড়িয়ে শুধু প্রথম ধাপের (অবকাঠামো নির্মাণ বাবদ) জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। প্রথমে প্রকল্প মেয়াদ ছিল ২০১৯ সাল পর্যন্ত। পরে সেটি ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। নানা খাতের খরচ বাড়ানোসহ সংশোধনের পর প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১২৪ কোটি ৭০ লাখ টাকায়। তবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ বাতিল করে। ফলে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রকল্প থেকে সরে আসে আরডিএ। পরে ভবনটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
আরডিএর নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, কমপ্লেক্সটি ভাড়া দেওয়ার জন্য গত ৭ জুলাই টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এর পর ১১ আগস্ট দরপত্র মূল্যায়ন করে কমিটি। দেবাশীষ কুমার প্রামাণিক, গোলাম রাব্বানী এবং সাইফুর রহমানের নামে তিনটি দরপত্র জমা পড়ে। কিন্তু শুধু দেবাশীষ কুমার প্রামাণিক ছাড়া বাকি দুজন দরপত্রের সঙ্গে জামানতের টাকা দেননি। যা টেন্ডার দাখিলের স্পষ্ট শর্ত লঙ্ঘন। তাই গোলাম রাব্বানী ও সাইফুরের ‘দরপত্র দুটি গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই’ বলে মত দেয় মূল্যায়ন কমিটি। ফলে দেবাশীষ কুমারের একটিমাত্র দরপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু একটি দরপত্র বৈধ হলে প্রতিযোগিতা হয় না। তাই পুনঃদরপত্র আহ্বানের নিয়ম। কিন্তু তা না করে একক দরদাতা দেবাশীষ কুমার প্রামাণিকের দর গ্রহণ ও ভাড়া প্রদানের সুপারিশ করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। অবৈধভাবে দরপত্র মূল্যায়নের পর রাতারাতি পরদিনই (১২ আগস্ট) দেবাশীষ কুমার প্রামাণিকের সঙ্গে ভাড়ার চুক্তি সম্পাদনের অনুমোদন দেন আরডিএর চেয়ারম্যান এসএম তুহিনুর আলম। দরদাতারা সবাই তুহিনুর রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। চেয়ারম্যানের ক্ষমতার প্রভাবে লোকদেখানো টেন্ডার আহ্বান করে কঠোর গোপনীতায় এই সিন্ডিকেটকে ২৯টি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাসহ বিভিন্ন ফ্লোরের ২৭ হাজার ১০০ বর্গফুট জায়গা ভাড়া দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তুহিনুর আলম ক্ষমতার অপব্যহার করে এই সিন্ডিকেটের কোনো কোনো ব্যক্তিকে ঢাকায় আরডিএর রেস্টহাউস ব্যবহারের সুযোগ দেন। রাজশাহী থেকে গিয়ে ওই রেস্টহাউস ‘প্রমোদখানা’ হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলেও অভিযোগ।
এ বিষয়ে আরডিএর চেয়ারম্যান তুহিনুর আলমের সঙ্গে দেখা করে বক্তব্য চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। পরে তিনি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মশিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে মশিউর রহমানও কোনো কথা বলেননি। পরে আরডিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক আব্দুল্লাহ আল তারিক বলেন, ‘অনেক বড় ভবন এটি। ভবনটি রক্ষণাবেক্ষণের মতো আমাদের সক্ষমতা নেই। এ কারণে কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। টেন্ডারে কোনো অনিয়ম হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, ওই কমপ্লেক্সে জুলাই স্মৃতি গ্যালারির জন্য কিছু জায়গা রাখা হয়েছে।
এদিকে আরডিএর কমপ্লেক্সটি জুলাইয়ে চেতনাবিরোধী ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া বাতিলের দাবিতে গত বুধবার ভবনটির সামনে বিক্ষোভ মিছিল এবং মানববন্ধনও অনুষ্ঠিত হয়। এনসিপির রাজশাহী মহানগর শাখার আহ্বায়ক মোবাশ্বের আলী বলেন, ‘কমপ্লেক্সটি ভাড়া দেওয়ার জন্য নির্মিত হয়নি। বরং আরডিএর উদ্যোগেই জুলাইয়ের চেতনা ধারণ ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে এখানে জুলাই স্মৃতি জাদুঘর হওয়া উচিত ছিল।
জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও রাকসুর এজিএস এমএম সালমান সাব্বির বলেন, ‘যে স্কুলটিকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে তার আসল মালিক ফ্যাসিবাদের দোসর কারাগারে। জুলাই বিপ্লবপরবর্তী ফ্যাসিবাদের কোনো চিহ্ন আমরা রাখতে দেব না। কাজেই আরডিএ বা যারাই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
আরডিএ কমপ্লেক্সের ভাড়া গ্রহীতা দেবাশীষ কুমার প্রামাণিক বলেন, কোনো সিন্ডিকেট নয় সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে আমি ভাড়া পেয়েছি। তবে দেবাশীষ কুমারের পার্টনার ক্যামব্রিয়ান স্কুলের দায়িত্বে রয়েছেন রমেন্টু চাকমা। তিনি জানান, লায়ন খায়রুল বাশারের কাছ থেকে তারা ক্যামব্রিয়ান স্কুলের ফ্র্যাঞ্চাইজি হিসেবে রাজশাহীতে শাখা খুলছেন। যদিও ক্যামব্রিয়ানের স্কুলের সরকারি অনুমোদন নেই। তবে অনুমোদনের জন্য তারা আবেদন করেছেন।