‘অপারেশন রুমে শুধু বাবার ‘‘আ আ’’ শব্দ শুনছিলাম’

রংপুর প্রতিনিধি
০৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৮:৩৮
শেয়ার :
‘অপারেশন রুমে শুধু বাবার ‘‘আ আ’’ শব্দ শুনছিলাম’

রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার ভুলে সাবেক ইউপি সদস্যের মৃত্যুর অভিযোগকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) রাতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বহিরাগতদের সহযোগিতায় রোগীর স্বজনদের আটকে রেখে মারধরের অভিযোগ উঠেছে।

শুক্রবার (৭ নভেম্বর) বিকেলে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন রংপুর কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান।

মৃত মোকছেদুল আলী (৬০) নীলফামারীর ডোমার উপজেলার বমুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও সাবেক ইউপি সদস্য। পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসা ও দালাল চক্রের প্রতারণায় মোকছেদুলের মৃত্যু হয়েছে।

পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য অনুযায়ী, হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে বুধবার (৫ নভেম্বর) রাতে মোকছেদুলকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে চিকিৎসক ডা. মো. আবু জাহিদ বসুনিয়া তার এনজিওগ্রাম করেন। এ সময় ওই চিকিৎসক রোগীর হার্টে রিং পড়ানোর কথা বললেন। পরে তারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সময় নিয়ে রিং পড়ানোর বিষয়ে ঢাকায় খরচসহ আনুষাঙ্গিক বিষয়ে খোঁজ নেওয়া শুরু করে। এর মধ্যে রোগীর অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে সাফিউলকে ‘ভুল’ বুঝিয়ে একটি বন্ডে স্বাক্ষর করিয়ে দ্রুত রিং পরানোর সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসক। অপারেশন চলাকালীন অবস্থায়ই মোকছেদুল মারা যান বলে পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন।

স্বজনদের অভিযোগ, রোগী মৃত্যুর পরেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃতদেহকে আইসিইউতে জীবিত হিসেবে প্রদর্শনের চেষ্টা করে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে স্বজনরা জোরপূর্বক আইসিইউতে প্রবেশ করলে মোকছেদুলকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। মুহূর্তেই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভে প্রচার করা হলে হাসপাতালের কর্মচারী ও তাদের সহযোগীরা স্বজন ও উপস্থিতদের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। এতে কারমাইকেল কলেজ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ অনেকে আহত হন।

নিহতের ছেলে শাফিউল ইসলাম বলেন, ‘অপারেশন রুমে শুধু বাবার ‘আ আ’ শব্দ শুনছিলাম। পরে যখন আইসিইউতে নেওয়া হয়, বাবা কোনো নড়াচড়া করেননি। আমরা বুঝে গেছি তখনই বাবা মারা গেছেন। কিন্তু হাসপাতাল তা গোপন করে।’

নিহতের শ্যালক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আইসিইউতে ঢুকে দেখি আমার দুলাভাই অনেক আগেই মারা গেছেন। আমি ফেসবুকে লাইভে গেলে হাসপাতালের পেটোয়া বাহিনী আমার ওপর চড়াও হয়।’

এ ঘটনার পর রাত ৯টার দিকে এলাকাবাসী হাসপাতাল ঘেরাও করে দোষীদের শাস্তি দাবি করে। স্থানীয়রা বলেন, হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত একটি দালাল চক্র প্রায় দেড় লাখ টাকা হাতিয়ে অপারেশনের ব্যবস্থা করেছিল।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও বহিরাগতদের মারধরের স্বীকার মৃত রোগীর স্বজন। ছবি: আমাদের সময় 

এ ঘটনায় হামলার শিকার হওয়া রোগীর স্বজন আব্দুল্লাহ সরকার নীলয় বলেন, ‘চিকিৎসার ভুলে অপারেশন থিয়েটারে রোগী মারা যাওয়ার পরে নিজেদের দূর্বলতা ঢাকতে মৃত রোগীকে জীবিত দেখিয়ে হাসপাতালের আইসিউতে ওরা ভর্তি দেখায়। এ বিষয়টি নিয়ে আমি ফেসবুকে লাইভ শুরু করলে বহিরাগত সন্ত্রাসীরাসহ স্টাফরা আমার ওপর হামলা চালায়। এ সময় আমি ও বাঁধন কুমার,ইউনুসসহ ২/৩ জন আহত হই।পরবর্তীতে আমাদের জিম্মী করে লাশ বুঝিয়ে দেয়। একই সঙ্গে শনিবার (৮ নভেম্বর) সকাল ১০টার মধ্যে তারা ভুল চিকিৎসার জন্য মিডিয়ার সামনে ক্ষমা চাইবে বলে জানায় ও হামলাকারীদের বিচার নিশ্চিত করবে। এই দুই শর্তে আমরা লাশ নিয়ে চলে আসার পরে দেখি ওরা নিজেদের মনগড়া একটি সংবাদ সম্মেলন করেছে। আমরা সরকার প্রধানের কাছে বিচার চাই।’

অন্যদিকে, হাসপাতালের পরিচালক মেরাজ মহসিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই জড়িত নয়। রোগী নিজেই পরামর্শ নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। আমরা কেবল অপারেশন থিয়েটার ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলাম। রোগীর অবস্থা খারাপ হলে আইসিইউতে নেওয়া হয় এবং সেখানে মারা যান। পরে স্বজনরা জোর করে প্রবেশ করে ফেসবুকে লাইভে যান।’

ঘটনার পর রোগীর স্বজনদের লাশ বুঝিয়ে দিয়ে রাত ৩টায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক প্রেস কনফারেন্স করে, যা নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। এলাকাবাসী ও স্বজনরা দ্রুত ঘটনাটির নিরপেক্ষ তদন্ত এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও দালাল চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. বসুনিয়া বলেন, ‘এনজিও গ্রামের আগেই রোগীর শ্যালক ও নিকটাত্মীয়রা পরামর্শ করে রোগীর ছেলে স্বাক্ষর দিয়ে রিং পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। হার্টের মধ্যে অ্যাভনরমাল কারেন্ট উৎপন্ন হয়ে হার্টের গতি বেড়ে গেলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। প্রতিনিয়তই এই সমস্যার কারণে ভালো রোগী হঠাৎ করেই মারা যাচ্ছে। মোকছেদুল নামের রোগীকে রিং পড়ানোর পরে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। তখন তাকে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয়বার রাত ৮ টায় কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়। রোগীটি মারা যায়। হার্টের রোগী যেকোনো সময় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে। আমি জীবনে শতাধিক রোগীর হার্টে রিং পড়িয়েছি ও হাজারের ওপরে এনজিওগ্রাম করেছি। এ ধরনের ঘটনা ১০০-এর মধ্যে দুই একটি হয়।’

রংপুর কোতয়ালী থানার ওসি আতাউর রহমান বলেন, ‘ডিমলার মোকছেদুল নামের এক ব্যক্তি আবু জাহিদ স্যারের কাছে আসলে তিনি ডক্টরদের দ্রুত অপারেশন করার পরামর্শ দেন। ভর্তি হওয়ার পরে অপারেশন চলাকালীন তার মৃত্যু হয়। তার শ্যালক প্রতিবাদ করায় হাতাহাতি হয়। এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষ অভিযোগ দায়ের করেনি। রোগীর স্বজন ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছে, তারা নিজেরা আপস মীমাংসা করে নিয়েছে। তবে আপস মীমাংসার বিষয়টি অস্বীকার করেছে রোগীর স্বজনরা।’

আমাদের সময়/আরডি