টিকিট কারসাজিতে থাকছে জেল-জরিমানার বিধান

বেবিচক চেয়ারম্যানের ক্ষমতা কমছে; কর্তৃত্ব বাড়ছে মন্ত্রণালয়ের ।। ফি, চার্জ, রয়্যালটি ও প্রিমিয়াম নির্ধারণে হবে অর্থনৈতিক কমিশন ।। কোনো রুটে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে ব্যবস্থা নিতে পারবেন চেয়ারম্যান

গোলাম সাত্তার রনি
০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:০৪
শেয়ার :
টিকিট কারসাজিতে থাকছে জেল-জরিমানার বিধান

১৯৬০ সালে প্রণীত সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্ডিন্যান্স রহিত করে ‘বেসামরিক বিমান চলাচল (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫’ নামে একটি অধ্যাদেশ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের খসড়ায় কর্তৃপক্ষ ও গ্রাউন্ড অপারেটরের ধার্যকৃত ফি, চার্জ, রয়্যালটি ও প্রিমিয়াম নির্ধারণে একটি অর্থনৈতিক কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যে কমিশন স্বাধীনভাবে সুপারিশ করতে পারবে। তবে এসব সুপারিশের বাস্তবায়ন সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক হবে না। কোনো ট্রাভেল এজেন্সি বিমান টিকিট মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করলে কিংবা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা নিলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ জন্য প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে জেল ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

বিমান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, অধ্যাদেশে বিমান চলাচল খাতকে আধুনিক, স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানে রূপ দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলেছেন, এ আইনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয় কার্যত কর্তৃপক্ষের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। এ ছাড়া এতে বেবিচকের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।

সূত্র মতে, খসড়া অধ্যাদেশে বেবিচকের সব নীতি, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, আর্থিক ফি নির্ধারণ ও লাইসেন্সিং কার্যক্রমে মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তদারকি ও অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে বেবিচকের স্বাধীন নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বেবিচকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হঠাৎ করে আইন পরিবর্তন করা হচ্ছে। কিন্তু কেন? তা কেউ জানে না। মনে হচ্ছে, বেবিচকের ওপর মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। এতে আমাদের স্বাধীনতা কমে যাবে।

অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছেÑ বেবিচক চেয়ারম্যান শিকাগো কনভেনশনের পরিশিষ্ট ও আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান পরিবহনের রীতি অনুসারে নিরাপত্তা, সেবা ও বিধান জারি করতে পারবেন। তবে বাস্তবায়নের আগে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে।

অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী, কোনো ট্রাভেল এজেন্সি যাত্রীর কাছ থেকে ট্যারিফের অতিরিক্ত মূল্য আদায় করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের কারণে দায়ী ট্রাভেল এজেন্সিকে অধ্যাদেশের বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে আদায়কৃত অতিরিক্ত অর্থের তিনগুণ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে যাত্রীকে। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা ট্রাভেল এজেন্সি টিকিট মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ জন্য অনধিক ৫ বছর এবং অন্যূন ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এতে আরও বলা হয়েছেÑ এয়ার অপারেটরদের তাদের সকল রুটের সকল শ্রেণির ন্যূনতম ও সর্বোচ্চ ট্যারিফ বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ও নির্দিষ্ট সময় অন্তর চেয়ারম্যানের নিকট দাখিল করতে হবে। এ ছাড়া কোনো রুটে একচেটিয়া কারবার, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বা কৃত্রিম সংকট পরিলক্ষিত হলে চেয়ারম্যান জনস্বার্থে যুক্তিসঙ্গত মূল্য নির্ধারণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।

অধ্যাদেশের খসড়ায় আরও বলা হয়েছেÑ সরকার বিমান চলাচল ও পরিবেশ সুরক্ষায় টেকসই জ্বালানি ব্যবহারে নীতি প্রণয়ন করবে এবং প্রয়োজনে প্রণোদনা দেবে।

খসড়ায় বিদেশি এয়ার অপারেটরদের বাংলাদেশে নিজস্ব কার্যালয় খুলে সরাসরি ব্যবসা পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বর্তমানে বিদেশি এয়ারলাইনগুলো শুধু স্থানীয় জেনারেল সেলস এজেন্টের (জিএসএ) মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।

বিমান পরিবহন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, সরকার এখন বুঝতে পারছে, যাত্রীদের স্বার্থে বাজারে আরও প্রতিযোগিতা দরকার। কিছু জিএসএ পরস্পরের আঁতাত করে দাম বাড়ায়। আইন পরিবর্তন হলে এ সমস্যা অনেকটাই কমবে।

অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী, কোনো গ্রাউন্ড অপারেটর নিবন্ধিত না হলে বাংলাদেশে উক্ত অপারেটর কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। গ্রাউন্ড অপারেটরকে নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত পদ্ধতিতে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হবে। চেয়ারম্যান যদি মনে করেন, নির্ধারিত শর্ত পূরণ করা হয়েছে, তা হলে তিনি নিবন্ধন সার্টিফিকেট প্রদান করবেন। এ ছাড়া কোনো গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম নিবন্ধিত না হলে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমকে নিবন্ধনের জন্য বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হবে। আবেদন প্রাপ্তির পর চেয়ারম্যান যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, নির্ধারিত শর্ত পূরণ করা হয়েছে, তাহলে তিনি নিবন্ধন সার্টিফিকেট প্রদান করবেন।

যদি কোনো নিবন্ধিত গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ-পরিপন্থি অপব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে চেয়ারম্যান উক্ত গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে বিদ্যমান সকল বুকিং জনস্বার্থে অক্ষুণ্ন রেখে তার নিবন্ধন সাময়িকভাবে স্থগিত বা বাতিল করতে পারবেন।

বেবিচকের কর্মকর্তাদের একাংশ মনে করছে, এ নতুন কাঠামোয় মন্ত্রণালয়ের তদারকি এতটাই বিস্তৃত হচ্ছে যে, কর্তৃপক্ষের নীতিনির্ধারণী স্বাধীনতা কার্যত বিলুপ্ত হবে। খসড়া বিধিমালার বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বোর্ড ও কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার পার্থক্য স্পষ্ট না থাকায়, তা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।