ট্রলি সংকটে বিমান থেকে পণ্য খালাসে জট

গোলাম সাত্তার রনি
০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:১০
শেয়ার :
ট্রলি সংকটে বিমান থেকে পণ্য খালাসে জট

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মালামাল খালাসের জন্য ট্রলির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে যথাসময়ে বিমানের পণ্য খালাসে বড় ধরনের ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এতে শুধু কার্গো অপারেশনই নয়, বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের কাজও ব্যাহত হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত বিমান সিডিউলে সমস্যা হচ্ছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ৯ নম্বর গেট দিয়ে কার্গো খালাসের প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে। ট্রলির অভাবে বিপুল পরিমাণ কার্গো হ্যাঙ্গারের সামনে পর্যন্ত জমে গেছে; এর ফলে ইঞ্জিন পরীক্ষাসহ (গ্রাউন্ড রান ও রানআপ) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, এখনকার অবস্থা অত্যন্ত সংকটপূর্ণ। ট্রলির সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে, একবার কার্গো নামানোর পর ট্রলি আটকে থাকছে। ফলে নতুন করে কোনো পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না। থার্ড টার্মিনালের তিনটি বে থাকা সত্ত্বেও সেখানে কোনো উড়োজাহাজ সঠিকভাবে রাখা যাচ্ছে না। এর প্রভাব পড়ছে ফ্লাইট সিডিউলে; একাধিক ফ্লাইট দেরিতে ছাড়ছে।

রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের আরেক কর্মকর্তা জানান, হ্যাঙ্গারের সামনে বিপুল পরিমাণ লাগেজ ও কার্গো রাখার কারণে ইঞ্জিন গ্রাউন্ড রান দেওয়া যাচ্ছে না। ইঞ্জিন চালু করে পরীক্ষা বা রানআপ করার জায়গা না থাকায় রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটি শুধু একটি টেকনিক্যাল সমস্যা নয় বরং পুরো অপারেশনাল চেইনের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। ফ্লাইট প্রস্তুতিতে বিলম্ব, শিডিউল পুনর্নির্ধারণ এবং যাত্রীসেবা ব্যাহত হচ্ছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সংস্থাটি নিজস্ব উদ্যোগে নতুন ট্রলি তৈরি করছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ট্যানারি করপোরেশন (বিটিএমসি) এবং এমটিএফের মাধ্যমে অতিরিক্ত ট্রলি সরবরাহের চেষ্টা চলছে। মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে জরুরি ভিত্তিতে ২৫০টি ট্রলির অর্ডার দেওয়া হয়েছে।

একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, নতুন ট্রলি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। ট্রলি সংকটের কারণে পণ্য খালাসে যে জট তৈরি হয়েছে, সেটি এখন পুরো কার্গো হ্যান্ডলিং চেইনে চাপ তৈরি করছে। একদিকে আগত পণ্য জমে আছে, অন্যদিকে পাঠানোর কাজ বিলম্বিত হচ্ছে।

বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনাল এলাকায় প্রতিদিন গড়ে কয়েক হাজার টন পণ্য ওঠানামা করে। এসব পণ্য হ্যান্ডলিং, স্ক্যানিং, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স এবং পরিবহনের প্রতিটি ধাপে ট্রলির ভূমিকা অপরিহার্য। ট্রলির সংকটে এক ধাপের বিলম্ব পুরো প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিচ্ছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার বোশরা ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমানে ৯ নম্বর গেট দিয়ে পণ্য খালাস হচ্ছে। এটির দূরত্ব বেশি হওয়ায় মালামাল পরিবহনে সময় লাগছে। এ কারণে ট্রলি সংকট দেখা দিয়েছে। আমরা মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কাছে দ্রুত ট্রলি সরবরাহের অনুরোধ করেছি। ট্রলি এলে এ সংকট কেটে যাবে।

একজন অভিজ্ঞ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কর্মী বলেন, আমরা অনেক সময় খালি ট্রলি পেতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করছি। এই সময়ের মধ্যে নতুন পণ্য নামানো বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে প্রতিটি ধাপে জট তৈরি হচ্ছে। কিছু ফ্লাইটে লোডিং সম্পন্ন করতে ৩০ মিনিটের জায়গায় দেড় ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এখনই সংকট সমাধান না হলে আসন্ন শীত মৌসুমে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। শীত মৌসুমে হজ, পর্যটন ও ব্যবসায়িক যাত্রাসহ আন্তর্জাতিক মালবাহী ফ্লাইটের চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এই সংকটের প্রভাব শুধু বিমান পরিচালনায় নয়, বরং যাত্রী ও রপ্তানিকারকদের ওপরও পড়ছে। সময়মতো কার্গো ছাড়তে না পারায় কিছু রপ্তানি পণ্যের গুণমান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে কৃষিজ পণ্য, মাছ ও ওষুধজাত সামগ্রী যেগুলোর জন্য সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, সেগুলো ঝুঁকিতে পড়েছে।

একজন রপ্তানিকারক বলেন, আমাদের কয়েকটি চালান গতকাল সময়মতো ছাড়তে পারেনি। এর ফলে বিদেশি ক্রেতার সঙ্গে ডেলিভারি চুক্তিতে সমস্যা হচ্ছে। বিমানবন্দরের এমন সংকট আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে। ফলে বিমান অপারেটরদের সøট জটিলতায় পড়তে হচ্ছে, এতে জরিমানা গুনতে হয়।

বিমানবন্দরের কার্গো অপারেশনে যে চেইনভিত্তিক প্রক্রিয়া চলছে, সেখানে সামান্য বিলম্বও বড় ধরনের অপারেশনাল বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ট্রলি সংকটের এই দীর্ঘসূত্রতার দ্রুত সমাধান না হলে দেশের বাণিজ্যিক কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনায় সময়োপযোগী রক্ষণাবেক্ষণ ও সরঞ্জাম সরবরাহের সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া এমন সংকট বারবার ফিরে আসবে, যা দেশের অন্যতম ব্যস্ততম বিমানবন্দরের জন্য বড় ধরনের সতর্কবার্তা।