স্ট্রং রুমের ভাঙা ভল্টে মিলল ৮০টি রাইফেল-পিস্তল
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউসের স্ট্রং রুমে দুর্ধর্ষ চুরির পর ভাঙা ভল্টে পাওয়া গেছে ৮০টি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল সংখ্যক ম্যাগাজিন ও কার্তুজ। চুরির পর এসব আগ্নেয়াস্ত্র, গুলিসহ অন্য মালামাল পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সিসি ক্যামেরা পুড়ে যাওয়া এবং বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকার সুযোগ নিয়ে স্ট্রং রুমের তালা কেটে লুটপাট চালায় অপরাধী চক্র। তবে সুরক্ষিত স্ট্রং হাউসের ভল্ট ভাঙার পর কী পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও মালামাল চুরি হয়েছে সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। চুরির ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। তবে গতকাল রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিমান মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি চুরিরকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেনি। মূলত এ প্রতিবেদন থেকেই চুরি যাওয়া মালামালের পরিমাণ সম্পর্কে জানা যাবে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ২৮ অক্টোবর সকালে চুরির ঘটনা জানাজানি হয়। পরে ঢাকার বিমানবন্দর থানা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পুরো এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করে। পরদিন ২৯ অক্টোবর ভাঙা স্ট্রং রুমের সামনে পাঁচজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে মালামালের তালিকা করা হয়। বিমানবন্দর থানা পুলিশের জব্দ তালিকায় দেখা যায়, ভাঙা স্ট্রং রুম থেকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয় ৬৭টি অত্যাধুনিক পিস্তল, ১২টি শর্টগান, একটি অ্যাসল্ট রাইফেল, পিস্তলের ১৩৮টি খালি ম্যাগাজিন, ৯ মিমি ব্ল্যাংক কার্টিজ ৯৯১ পিস, শর্টগান ও রাইফেলের খালি ম্যাগাজিন জব্দ করা হয়। জব্দ তালিকা থেকে জানা যায়, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরও স্ট্রং রুম প্রায় অক্ষতই ছিল। অধিকাংশ আগ্নেয়াস্ত্রের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্রের প্লাস্টিক বাট, ব্যারেলের নিচের স্প্রিং ও ম্যাগাজিন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সুরক্ষিত স্ট্রং রুমের ভল্ট থেকে কী পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও মালামাল খোয়া গেছে কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র আদৌ লুট হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে গতকাল রাত পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। আগ্নেয়াস্ত্রসহ কী পরিমাণ মূল্যবান মালামাল স্ট্রং রুমে জমা ছিল; কী পরিমাণ মালামাল শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছে- এ দুই তালিকা ধরে খোয়া যাওয়া মালামালের হিসাব বের করছেন তারা।
কর্মকর্তারা জানান, বিমানবন্দরের কার্গো আমদানি হাউসের স্ট্রং রুমের ভল্টে সাধারণত মূল্যবান জিনিসপত্র ও জরুরি নথিপত্র (আমদানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, শুল্ক সংক্রান্ত ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক দলিলপত্র) রাখা হয়। এ ছাড়া খুব বেশি মূল্যবান কিছু আমদানিপণ্যও সাময়িকভাবে ভল্টে রাখা হয়। সাধারণত স্বর্ণ, হীরা ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ উচ্চমূল্যের ও সহজে বহনযোগ্য পণ্য নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়ে থাকে। সেখান থেকে পণ্য বের করতে হলে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দর ও স্ট্রং হাউস সম্পর্কে জানাশোনা আছে এমন শক্তিশালী চক্র এ চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে। এ কাণ্ডে গত ২৮ অক্টোবর বিমানবন্দর থানায় যে জিডি করা হয়, তাতে উল্লেখ করা হয়Ñ বিমানবন্দরের কার্গো আমদানি কমপ্লেক্সের স্ট্রং রুমের (ভল্ট) মালামাল ২৪ অক্টোবর বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বিমান সিকিউরিটির প্রতিনিধির স্বাক্ষরসহ ভল্টে শেকল দিয়ে তালা লাগিয়ে সিলগালা করা হয়েছিল। ২৮ অক্টোবর স্ট্রং রুমের ভল্টের কাছে গিয়ে কোনো তালা লাগানো দেখা যায়নি।
চুরির ঘটনা জানাজানির এক সপ্তাহ পর গত সোমবার বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. মো. সাফিকুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, গত ১৮ অক্টোবর কুরিয়ার গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়, যা পরবর্তী সময় আমদানি কার্গো গোডাউনে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে কুরিয়ার ও আমদানি কার্গো গোডাউন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কিন্তু আমদানি কার্গো গোডাউনের স্ট্রং রুম মেইন ওয়?্যারহাউস-১ এর ভল্টে রক্ষিত মালামাল অক্ষত থাকে। তবে ভোল্টের লক সিস্টেম পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। গত ২৩ অক্টোবর তদন্ত কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন করে ও ভল্টের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করে। ধ্বংসপ্রাপ্ত আমদানি গোডাউনের ল্যান্ড সাইডের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল এভসেক, ডিএমপি পুলিশ ও বিমান নিরাপত্তা বিভাগ। ল্যান্ডসাইডে বিমান নিরাপত্তার কাছে এন্ট্রি রেজিস্টার লিপিবদ্ধ করে পুলিশ এবং বিমান নিরাপত্তা সদস্য কর্তৃক এসকর্ট সহকারে বিভিন্ন সংস্থা প্রয়োজনে সেখানে প্রবেশ করে। এ ছাড়া এয়ারসাইডের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল এভসেক। তারাও এয়ারসাইড দিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত আমদানি কার্গো গোডাউনে প্রবেশের ক্ষেত্রে রেজিস্টারে অ্যান্ট্রি কার্যক্রম চালু রাখে।
চুরির ঘটনার ব্যাখ্যায় চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গত ২৪ অক্টোবর দুপুরে কাস্টমস, বিমান কার্গো, বিমান সিকিউরিটি, পুলিশ, এভসেক, এনএসআইয়ের উপস্থিতিতে স্ট্রং রুম ভল্টের ইনভেন্ট্রি তালিকা করা হয়। তালিকার পর সবার উপস্থিতিতে তালা সিলগালা করা হয়। ভল্টটির অবস্থান ধ্বংসপ্রাপ্ত ইমপোর্ট কার্গোর ভেতরে। ইমপোর্ট কার্গো বিল্ডিং সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় যে কোনো সময় ছাদ ভেঙে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া ছাদ থেকে ইট-সুরকি খসে পড়ছে, যা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। নিরাপত্তার জন্য ভল্টের সামনে প্রহরায় বিমান নিরাপত্তা বিভাগের লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। তবে বিল্ডিংটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পরে ভেতরে অবস্থান করা পুলিশ সদস্য ও বিমান নিরাপত্তা সদস্যদের বাইরে অবস্থান করতে বলা হয়। তা ছাড়া অগ্নি দুর্ঘটনার পর থেকে আমদানি কার্গোতে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না, সিসিটিভিও ছিল অকার্যকর।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
চিঠিতে বলা হয়, নিরাপত্তা ও ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করে ভল্টের মূল্যবান মালামাল অন্যত্র স্থানান্তরের জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের অনুরোধ করা হয়। গত ২৭ অক্টোবর সর্বশেষ ভল্টের তালা পরিদর্শনে ভল্টের মালামাল ঠিকঠাক পাওয়া যায়। তবে পরদিন ২৮ অক্টোবর সকালে ভোল্টের শেকলও তালাবিহীন অবস্থায় পাওয়া যায়।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গত ২৪ অক্টোবর ইনভেট্রি সম্পন্ন হওয়ার পর স্ট্রং রুমের চাবি কাস্টমস ও পুলিশের নিকট হস্তান্তরের অনুরোধ করা হয়। তবে তারা অপারগতা প্রকাশ করায় বিমান নিরাপত্তা বিভাগের শিফট অফিসে চাবির বক্সে চাবি সংরক্ষণ করা হয়। বিমান নিরাপত্তা শিফট অফিসে প্রবেশাধিকার অননুমোদিত ব্যক্তির জন্য সীমিত এবং সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা হয়। সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে কোনো গরমিল পাওয়া যায়নি। এ প্রেক্ষিতে আপাতদৃষ্টিতে তালাটি ভাঙা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
আগ্নেয়াস্ত্রের বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স জানায়, স্ট্রং রুমের তালা ভাঙার পর গত ২৯ অক্টোবর বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে স্ট্রং রুমে রক্ষিত আগ্নেয়াস্ত্রের ইনভেন্ট্রি করা হয়। এরপর বিমানবন্দর থানা পুলিশ ওই আগ্নেয়াস্ত্রগুলো নিজ হেফাজতে নিয়ে যায়। গত রবিবার স্ট্রং রুমের বাকি মালামাল তদন্ত কমিটি কর্তৃক পুনরায় ইনভেন্ট্রি করা হয়। ইনভেন্ট্রির তালিকার সঙ্গে স্ট্রং রুমে রাখা মালামালের কোনো গরমিল হয়েছে কিনা তা তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখছে।
আমাদের সময়ের হাতে আসা তথ্যে দেখা যায়, চুরি হওয়ার আগেই মালামাল হেফাজতে নিতে ঢাকা কাস্টম হাউস কমিশনারকে চিঠি দিয়েছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। গত ২৫ অক্টোবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে অবস্থিত প্রধান গুদাম-১ এর ‘স্ট্রং রুম-এ’তে রক্ষিত মালামালের ইনভেন্ট্রি যথানিয়মে সম্পন্ন হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ফলে বর্তমানে পণ্য আমদানি টার্মিনালের সব স্থাপনাসহ সব গুদাম ভস্মীভূত হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শুধু ‘স্ট্রং রুম-এ’ ছাড়া গুদামের অন্য কোথাও মালামাল অবশিষ্ট নেই। এহেন স্পর্শকাতর ও নাজুক পরিস্থিতিতে স্ট্রং রুম-এতে ইনভেন্ট্রিকৃত মূল্যবান মালামাল রাখা সমীচীন হবে না। মালামালের যথাযথ সুরক্ষায় কাস্টমস হেফাজতে নেওয়ার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।