প্রশংসায় ভাসছে তুহিনের কণ্ঠে কিংবদন্তি এডি পালমিয়েরির ‘ক্যাফে’ (ভিডিও)
এডি পালমিয়েরি ল্যাটিন জ্যাজের এক কিংবদন্তি নাম। ব্রঙ্কসের এই পিয়ানোবাদক ও ব্যান্ড লিডার সাত দশকের সংগীতজীবনে বদলে দিয়েছেন সালসা ও আফ্রো-কিউবান রিদমের ধারা। জ্যাজের স্বাধীনতা আর ক্যারিবীয় ছন্দের মেলবন্ধনে তার সৃষ্টিগুলো এক নতুন সংগীতভাষা তৈরি করেছে।
দ্য ম্যাডম্যান অব রিদম নামে পরিচিত এই শিল্পী ‘লা পারফেক্টা’র মতো বিখ্যাত ব্যান্ড গড়ে তুলেছিলেন। তিনি জিতেছিলেন অনেকগুলো গ্র্যামি পুরস্কার আর প্রভাব ফেলেছিলেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম সংগীতশিল্পীর মনে। তার সংগীত ছিল জ্ঞান আর আবেগের এক নিখুঁত সংমিশ্রণ।
তার অনেক বিখ্যাত কম্পোজিশনের মধ্যে ক্যাফে একটি। ষাটের দশকে লেখা এই গানটিতে আছে এক ধরনের নীরব বিষাদ—হারলেম ও হাভানার মাঝামাঝি কোন এক এলাকার এক বিকেলের মুড। ধোঁয়াটে ব্রাস, সিঙ্কোপেটেড পিয়ানো, আর একরাশ নিঃশব্দ একাকীত্ব।
এডি পালমিয়েরি গত আগস্ট মাসের ৭ তারিখে ৮৮ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান। তার মৃত্যুর পর কোক স্টুডিও বাংলার মাধ্যমে ক্যাফে যেন আবার ফিরে এলো। এটি কোনো সাদামাটা রিমেক নয়, বরং পুনর্জন্ম। গানটিতে আফ্রো-কিউবান জ্যাজের স্পন্দন মিশে গেছে বাঙালি সুরের আত্মায়। হারলেম থেকে হাভানা পেরিয়ে এবার গানটি পৌঁছেছে ঢাকা, কলকাতা আর ব্রাজিলের বাহিয়ায়—এক নিঃশ্বাসে মিলেছে তিন মহাদেশের সুর।
সময়টা সত্তরের দশক, শহর কলকাতা। মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের গৌতম চট্টোপাধ্যায় এডি পালমিয়েরির ক্যাফে থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখলেন আমার প্রিয়া ক্যাফে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথমদিকের ল্যাটিন জ্যাজ অণুপ্রাণিত স্বাধীন গানগুলোর একটি। গৌতমের কাছে ক্যাফে মানে ছিল আত্মসমালোচনা—নীরবতার মধ্যে জীবনের একাকীত্বকে খুঁজে পাওয়া।
আরও পড়ুন:
ওটিটি প্ল্যাটফরম আমার জন্য বেশ লাকি
অর্ধশতাব্দী পর সেই উত্তরাধিকার বহন করে ফিরেছেন তার ছেলে, গৌরব ওরফে গাবু চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গে আছেন বাংলাদেশের রকস্টার তানযীর চৌধুরী তুহিন ও ব্রাজিলের শিল্পী লিভিয়া মাতোস। তিনজন মিলে আবার জীবন্ত করে তুলেছেন ক্যাফে—এক নতুন রূপে, এক নতুন সংলাপে।
তুহিনের কাছে ক্যাফে কোনো কাভার নয়, বরং এক সংলাপ। তার কণ্ঠে গানটি যেন শহরের নিদ্রাহীন রাতের মনোলগ। প্রতিটি নোট, প্রতিটি বিরতি যেন এক গভীর নিঃশ্বাস। তার গলায় নীরবতা পর্যন্ত কথা বলে। তুহিন গানটিকে শুধু গেয়েছেনই না, শব্দ আর নীরবতার মাঝের সেই সূক্ষ্ম আবেগকে অনুভব করেছেন।
গাবু ড্রামে ও ভোকালে বাবার উত্তরাধিকারকে নতুনভাবে ছুঁয়েছেন। তার বাজনায় আছে স্মৃতি আর নিরীক্ষার সাহস। কলকাতার এক ছাদের ঘর থেকে ঢাকার স্টুডিও পর্যন্ত এই ছন্দ যেন একটি সেতুবন্ধন।
আরও পড়ুন:
নানাকে নিয়ে পরীর আবেগঘন পোস্ট
ব্রাজিলের লিভিয়া ম্যাটোস যোগ দিয়েছেন আকর্ডিয়ন আর কণ্ঠে। তার সুরে ফিরেছে ক্যাফের ল্যাটিন শিকড়। তার বাজনায় আছে রোদ্দুরের উষ্ণতা— যেন বৃষ্টির পর সূর্যের আলো ঢুকে পড়ছে ঘরে। তার কণ্ঠ মিশে যায় তুহিনের সঙ্গে, ভাষা আলাদা হলেও আবেগ এক।
এই পুরো আয়োজনের নেপথ্যে আছেন প্রযোজক শুভেন্দু দাস শুভ। লং ডিস্ট্যান্স লাভ বা বুলবুলি–র মতো কোক স্টুডিও বাংলার সেরা ট্র্যাকগুলোর পেছনের কারিগর ছিলেন তিনি। ক্যাফে-তে শুভ আফ্রো-কিউবান ও বাংলা জ্যাজের মিশেলে কম্পোজ করেছেন গানটি। ব্রাস ও বেসের সঙ্গে ইলেকট্রনিক টেক্সচার, আর লাইভ পারকাশনে উষ্ণতা ছড়িয়েছে গানটি হয়ে উঠেছে আধুনিক ও স্মৃতিময়।
এই ক্যাফে আসলে স্মৃতি ও ভূগোলের মধ্য দিয়ে এক যাত্রা। নিউ ইয়র্কের ষাটের দশকের জ্যাজ বারে শুরু হওয়া সুর পৌঁছে গেছে কলকাতার ছাদে, ঢাকার নতুন সংগীতজাগরণে, আর ব্রাজিলের রোদে। এতে আছে পালমিয়েরির ছন্দ, মোহিনের ঘোড়াগুলির দর্শন, আর তুহিনের নিঃশব্দ কবিতা।
তুহিনের কণ্ঠে ক্যাফে এক আয়না। সময়, একাকীত্ব আর দৈনন্দিন জীবনের নরম সৌন্দর্যের প্রতিফলন। কিন্তু যেখানে পালমিয়েরির মূল সংস্করণ ছিল ধীর ও বিষণ্ন, কোক স্টুডিও বাংলার ক্যাফে সেখানে অনেক বেশি প্রাণবন্ত, ছন্দময়। এখানে বিষাদ রূপ নেয় আনন্দে, আত্মমগ্নতা রূপ নেয় সংলাপে।
আরও পড়ুন:
‘এভাবে বিয়ে করা নাকি অর্থহীন’
এই গান আমাদের মনে করিয়ে দেয় সংগীতের বয়স হয় না, সে শুধু রূপ বদলায়। কিছু সুর কখনো শেষ হয় না; তারা অপেক্ষা করে। নীরবতার ভেতর, ছন্দের ভেতর যেন কোনো এক নতুন কণ্ঠ এসে আবার তাদের ঘরে ফিরিয়ে আনে।
আমাদের সময়/কেইউ