রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াবে সরকারের সিদ্ধান্ত

শাহজাহান মোল্লা
০৪ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০২
শেয়ার :
রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াবে সরকারের সিদ্ধান্ত

জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থানে কিংকর্তব্যবিমুখ অবস্থায় পড়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যার দায় ঐকমত্য কমিশনের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা মনে করেন, ঐকমত্য কমিশন দীর্ঘদিন ধরে আলাপ-আলোচনা করার পর যে বিষয়গুলো নিয়ে ঐক্য হলো, সেটাকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের মতো করে সুপারিশ করে রাজনৈতিক বিভেদ সৃষ্টি করেছে ঐকমত্য কমিশন। নতুন করে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়ায় সরকারের দূরদর্শিতা ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজনীতিবিদরা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা না থাকায় তারা রাজনীতিতে বিভেদের দেয়াল তৈরি করে দিচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।

জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এক সপ্তাহের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে না পারে, তা হলে সরকার তার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দলগুলো নাখোশ।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে দীর্ঘ সময় আলাপ-আলোচনা করে ১৭ অক্টোবর যে জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হলো, সেটা কীভাবে পাল্টে গেল। এখন এমন সময়ে এসে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে সমঝোতার চাইতে অনৈক্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি; যেখানে আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। রাজনৈতিক দলগুলো যখন নির্বাচনমুখী, অনেক দলই প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেÑ এ অবস্থায় দলগুলো নির্বাচনী প্রস্তুতি নেবে নাকি জুলাই সনদ নিয়েই বসে থাকবে? এভাবে বারবার রাজনৈতিক দলের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ায় সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।

সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর বসে ঐকমত্যে পৌঁছানো আহ্বান জানানোর পর ধর্মভিত্তিক আট দল প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও গণভোট আয়োজন নিয়ে মতপার্থক্য নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ চায়। সেই আলোচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘রেফারির’ ভূমিকায় থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের।

সরকারের এই আহ্বান ভালোভাবে নিচ্ছেন না রাজনৈতিক দলের নেতারা। এ বিষয়ে ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম আমাদের সময়কে বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সভায় আমরা প্রস্তাব করেছিলাম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন এক সঙ্গে গণভোট করার। ঐকমত্য কমিশন ঐক্য সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর যে দায়িত্ব দিয়েছে, সেটা দলগুলোর অন্দরে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা। আমরা চেষ্টা করব।

জুলাই সনদ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রতারণা করেছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের নেতারা। এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের প্রধান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ আমাদের সময়কে বলেন, রাজনৈতিক দল বসে সব ঠিকঠাক করে দিলাম। এখন আবার কিসের বসাবসি? আমরা যেটাতে স্বাক্ষর করে দিলাম, সেটা নেই। আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এটা সরকারকেই করতে হবে। আর দেশের এত টাকা নেই যে একদিন গণভোট আর একদিন সংসদ নির্বাচন। এই দাবি যারা তুলেছে তারা নির্বাচন পেছাতে চায়।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে মুখোমুখি করার চেষ্টা বলে মনে করেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে এভাবে মুখোমুখি করা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নয়। এখন কে কাকে ডাকবে? সেই সময় বা বাস্তবতা এখন নেই। সরকারেরই উচিত দলগুলো থেকে আলাদা আলাদা মতামত নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। আর গণভোট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন আলাদা দিনে হওয়ার মতো সময় বা পরিবেশ এই মুহূর্তে নেই। কাজেই একই দিনে আলাদা ব্যালটে গণভোট ও সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত।

এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব আমাদের সময়কে বলেন, ঐকমত্য কমিশন শেষ এক মাসে দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। দুটি বড় দল বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতার কাঠামো ঠিক করতে দরকষাকষি করেছে। কার কোনটা ছাড় দিলে ক্ষমতায় যেতে পারবেÑ এ নিয়ে তারা দরকষাকষি করেছে। এখন সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এভাবে বারবার রাজনৈতিক দলের ওপর সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়া সক্ষমতার অভাব। গণভোট আগে-পরে নিয়ে আমাদের কোনো কথা নেই। আমরা চাই, গণভোটের আদেশ জারি প্রধান উপদেষ্টাকেই করতে হবে এবং সেই আদেশের ভাষাগুলো আগে জনগণকে জানাতে হবে।