১৪ বছরে বিশেষ আইনে বিদ্যুৎ খাতে মহাদুর্নীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক
০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০২:১৮
শেয়ার :
১৪ বছরে বিশেষ আইনে বিদ্যুৎ খাতে মহাদুর্নীতি

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১) করা হয়। এরপর ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে এ আইনের অধীনে বিদ্যুৎ খাতে ভারতের আদানিসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা চুক্তি ও প্রকল্পে মহাদুর্নীতি হয়েছে। সরকার গঠিত উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আগামী জানুয়ারিতে এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে কমিটি।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক, আমলা ও রাজনীতিবিদদের যোগসাজশে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এর ফলে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বিদ্যুতের দাম ২৫ শতাংশ বেশি। ভর্তুকি বাদ দিলে যা ৪০ শতাংশে পৌঁছবে। এ সময়কালে বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ অথচ খরচ বেড়েছে ১১ গুণ। বিদ্যুতের এমন দাম বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারবে না।

বিশেষ আইনে সম্পাদিত বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো পর্যালোচনার লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় কমিটি গতকাল রবিবার বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কাছে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের অংশবিশেষ হস্তান্তর করেছে। এ সময় কমিটির সদস্যরা সাংবাদিকদের প্রশ্নে এসব তথ্য জানান। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে

গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (বুয়েট) আবদুল হাসিব চৌধুরী, বহুজাতিক অডিট ফার্ম কেপিএমজি বাংলাদেশের প্রাক্তন চিফ অপারেটিং অফিসার আলী আশরাফ, বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল’ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শাহদীন মালিক। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এ কমিটি গঠন করা হয়। এর এক বছরেরও বেশি সময় পর, গতকাল অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিটি।

সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেন, আদানির চুক্তিতে যদি কোনো রকম অনিয়ম পাওয়া যায়, তাহলে বাতিল করতে দ্বিধা করব না। প্রতিটি চুক্তিতেই স্বীকারোক্তি থাকে যে, এই চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। কিন্তু তা ভঙ্গ হলে চুক্তি বাতিল করা যায়।

আমলাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, সবার সহযোগিতা পেলে দুদকের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রাপ্ত তথ্যাদি নিয়ে দুদকের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। বিভাগীয়ভাবে করার তেমন কিছু নেই। কারণ অনেকেই চাকরি ছেড়েছেন।

কমিটির আহ্বায়ক বিচারপতি মইনুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের আমলে দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ আইনের আওতায় বড় ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে। এসব চুক্তি হয়েছে বিভিন্ন দেশের কোম্পানির সঙ্গে। ভারতের আদানিসহ যেসব কোম্পানি এসবের সঙ্গে জড়িত, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান বলেন, যে চুক্তিগুলো হয়েছে সেগুলো সার্বভৌম চুক্তি। একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে, একটি কোম্পানির চুক্তি সই হয়েছে। সার্বভৌম চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। যদি মনে হয় এখানে কোনো কারচুপি হয়েছে, আপনি ইচ্ছামতো এটা বাতিল করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে আপনার ওপর অনেক বড় জরিমানা আসবে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে। এ জন্যই আমাদের অনেক সময় লেগেছে চুক্তির প্রক্রিয়াগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখতে। আমরা যে বিষয়গুলো পেয়েছি, এর সবকিছু অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে নেই। কারণ কিছু কিছু জিনিস চলমান। এ জন্য সেগুলো প্রকাশ করিনি। তিনি বলেন, মাসখানেকের মধ্যে আরও অনেক দুর্নীতির তথ্য পাবেন। এখানে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে, এই দুর্নীতি আমাদের রোধ করতেই হবে। ইতোমধ্যে আমাদের দেশে বিদ্যুতের দাম আমাদের প্রতিযোগীদের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে এই দুর্নীতির কারণেই। ভর্তুকি সরিয়ে দিলে এটা হয়তো ৪০ শতাংশ হয়ে যাবে। আমাদের হিসাবে, বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকতে পারবে না বিদ্যুতের এমন দামে। তাই আমাদের এসব চুক্তি শোধরাতেই হবে।

মোশতাক হোসেন আরও বলেন, প্রতিবেদনে আছে কোথায় কোথায় ভুল হয়েছে, হস্তক্ষেপ করা হয়েছে, ওপর থেকে হুকুম এসেছে। প্রশাসন সবসময় নির্দোষ ছিল, তাও না। এরও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মাশুলটা দিচ্ছে সাধারণ ভোক্তা-ক্রেতা, করদাতারা। তিনি বলেন, বিশাল অংকের ঋণ ও বেশি দামের বিদ্যুৎ চাপিয়ে দিয়ে যারা এখান থেকে টাকা নিয়ে চলে গেছে, তাদের বোঝাতে হবেÑ আপনারা এটা থেকে পার পাবেন না। আমরা প্রমাণ সংগ্রহ করছি, অ্যাকশন নেওয়া হবে। ভবিষ্যতে যাতে এটা আর না হয়। এটা অনেক কঠিন কাজ। সবাইকে একটু ধৈর্য ধারণ করতে হবে।

বিশেষ আইনের চুক্তি নিয়ে দুটি রিট পিটিশন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথম রিট পিটিশন করেছিলেন শাহদীন মালিক। দ্বিতীয় রিট পিটিশনে আদালত একটা রুলিং দিয়েছেÑ ৬০ দিনের মধ্যে দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আদালতে রিপোর্ট দিতে হবে। আমরা সেই কাজেও সহায়তা করছি। আপনারা মাসখানেকের মধ্যে এ খাতে দুর্নীতির শক্ত প্রমাণ পাবেন। তিনি বলেন, সেটা যখন হবে তখন আদানি এবং আরও কয়েকটি বড় কোম্পানির বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া চালু করা হবে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ কেনার জন্য যে চুক্তিগুলো হয়েছিল, বড় বড় কেসগুলোর ক্ষেত্রে আমরা সংশ্লিষ্ট নথিগুলো দেখেছি। ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন চার গুণ বেড়েছে। কিন্তু অর্থ পরিশোধ বেড়েছে ১১ দশমিক ১ গুণ। এটি কোনোভাবে ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। ২০১১ সালে বিদ্যুতের জন্য ৬৩ দশমিক ৮ কোটি ডলার পরিশোধ করেছিলাম, যেটা ২০২৪-এ এসে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। কাদের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে কি পরিমাণ বিদ্যুৎ পাচ্ছিÑ সেই হিসাব মেলানো যায় না। বিশেষ বিধান আইনে বারবার মেয়াদ বাড়ানো হলো, বারবার দায়মুক্তির পথ খুলে গেল। এ ছাড়া আছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণ। বিদ্যুৎ জ্বালানি মন্ত্রণালয় সবসময় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ছিল। ওখানেও সমস্যা আছে।

আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, চুক্তি বাতিল করার যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। কিন্তু আমরা এখানে বাতিল করলে তারা আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারে। তাই বুঝে শুনে চুক্তি বাতিলের দিকে যেতে হবে। তিনি বলেন, ৩০ শতাংশ জেতার সম্ভাবনা থাকলে আমরা আদালতে যাব না। যদি দেখি আইনগতভাবে ৮০ শতাংশ জেতার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে অবশ্যই আইনগতভাবে মোকাবিলার পরামর্শ দেব সরকারকে। আগেই সব তথ্য প্রকাশ করলে অনেক ক্ষতি হতে পারে। তাই সব কথা বলতে চাই না, যোগ করেন তিনি।