দুই সেনাপতির দ্বন্দ্ব: সুদান যেন মৃত্যুপুরী

আজহারুল ইসলাম অভি
০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৭
শেয়ার :
দুই সেনাপতির দ্বন্দ্ব: সুদান যেন মৃত্যুপুরী

সুদানে ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া সংঘাত এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যায় রূপ নিয়েছে। সেনাবাহিনীর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেলের ক্ষমতার লড়াইয়ে নিষ্পেষিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিশেষত পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে যেন হত্যা থামছেই না। জাতিগত নির্মূলের এই ভয়ংকর খেলায় লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত, আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন -আজহারুল ইসলাম অভি

গণহত্যার কারণ

দুই জেনারেলের ক্ষমতা দখল

শুরু : সংঘাতের সূত্রপাত ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল, যখন সুদানের সামরিক বাহিনীর ((SAF- Sudan Armed Forces)) প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং শক্তিশালী আধাসামরিক গোষ্ঠী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর মধ্যে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তীব্র লড়াই শুরু হয়।

পটভূমি : ২০১৯ সালে দীর্ঘকালীন স্বৈরশাসক ওমর আল-বশিরের পতনের পর, বুরহান ও দাগালো যৌথভাবে ২০২১ সালে অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং একযোগে দেশ চালাচ্ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আরএসএফকে সেনাবাহিনীতে একীভূত করা এবং ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নে তাদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়, যা যুদ্ধ অনিবার্য করে তোলে।

সম্পদ ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ

জেনারেল দাগালো তার আরএসএফ বাহিনীর মাধ্যমে সুদানের কিছু সোনার খনি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে এই সোনা পাচার করেন। সুদানের প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৌশলগত অবস্থান ঘিরে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও এই সংঘাতকে ইন্ধন জুগিয়েছে।

জাতিগত নির্মূল অভিযান

দারফুর অঞ্চলে আরএসএফ ও তাদের সহযোগী মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে মাসালিত এবং অন্যান্য অনারব সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ভয়াবহ গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযান চালানোর অভিযোগ রয়েছে। (সূত্র : হিউম্যান রাইটস ওয়াচ)। দারফুরের অনেক বাসিন্দা মনে করেন, আরএসএফ ও সহযোগী মিলিশিয়ারা এই অঞ্চলটিকে আরব-শাসিত অঞ্চলে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধ চালাচ্ছে।

কারা জড়িত

অভ্যন্তরীণ পক্ষ

র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) : জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর নেতৃত্বাধীন এই আধাসামরিক গোষ্ঠী গণহত্যার মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত। এই বাহিনী মূলত কুখ্যাত জানজাওয়িদ মিলিশিয়া থেকে উদ্ভূত, যারা ২০০৩ সালের দারফুর সংঘাতেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ছিল।

সুদানি সশস্ত্র বাহিনী (SAF) : জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী আরএসএফের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তাদের বিরুদ্ধেও বেসামরিক এলাকায় বোমা হামলা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।

বিদেশি (আরব ও অন্যান্য) সমর্থন

সুদানের গৃহযুদ্ধে বেশ কিছু বিদেশি শক্তি জড়িয়ে পড়েছে। এই সংঘাতকে জিইয়ে রাখতে বাইরে থেকে অস্ত্র ও যোদ্ধা প্রবেশ করছে বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) : সুদানের সেনাবাহিনী সরাসরি সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে আরএসএফকে সমর্থন দেওয়া ও ড্রোন হামলা চালানোর অভিযোগ করেছে। যদিও আরব আমিরাত তা অস্বীকার করেছে, তবে জাতিসংঘের প্রতিবেদন ও স্বাধীন তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে।

মিশর : সুদানের সেনাবাহিনীর (SAF) প্রধান সমর্থক দেশ হলো মিশর। তারা বুরহানকে বৈধ শাসক হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে।

লিবিয়া : লিবিয়ার নেতা খলিফা হাফতারের বিরুদ্ধে আরএসএফকে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে।

নিন্দা জানিয়েছে যারা : সৌদি আরব, মিশর (সেনাবাহিনীর সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও), কাতার, তুরস্ক ও জর্ডানের মতো আরব দেশগুলো এল-ফাশেরে আরএসএফের গণহত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।

মানবিক বিপর্যয়

ক্ষয়ক্ষতি

যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে বলে জানা যায় (জাতিসংঘের হিসাবে), যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (UNHCR) হিসাব অনুসারে, এই সংঘাতের ফলে ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা সুদানকে বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু সংকটে পতিত করেছে।

মানবিক সংকট

যুদ্ধ, খাদ্যসংকট, চিকিৎসাসেবার অভাব এবং চরম আতঙ্কের পরিবেশে সুদানের সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ২ কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষ চরম খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন।

মানসিক স্বাস্থ্য

তীব্র সহিংসতা, স্বজন হারানো, বাস্তুচ্যুতি, চরম দারিদ্র্য এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা সুদানের জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ধর্ষণসহ যৌন সহিংসতাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ঘটনাও নথিভুক্ত করা হয়েছে, যা নারীদের মধ্যে চরম মানসিক ট্রমা ও হতাশার সৃষ্টি করেছে।

বুরহান ও দাগালোর মধ্যকার উত্তেজনার শুরু

সালটা ১৯৮৩। কেবল শুরু হয়েছে দ্য সেকেন্ড সুদানিস সিভিল ওয়ার। এই সিভিল ওয়ার মূলত দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতা আন্দোলন নামে পরিচিত। গৃহযুদ্ধের কারণে সুদানের রাজনৈতিক অবস্থা তখন বেশ নড়বড়ে। ভঙ্গুর রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে ১৯৮৯ সালের ৩০ জুন একটা রক্তপাতহীন সামরিক বিপ্লব হয়, যে বিপ্লবের মাধ্যমে মিলিটারি অফিসার ওমর আল-বশির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সাদিক আল-মাহাদিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদটিকে বিলুপ্ত করেন। তিনি হয়ে ওঠেন সুদানের স্বৈরশাসক। তিনি ১৯৮৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কোনো ধরনের বেসামরিক জনপ্রতিনিধি ছাড়াই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তার ক্ষমতাকালেই ২০১১ সালে সুদান ভেঙে আরেক নতুন রাষ্ট্র দক্ষিণ সুদানের জন্ম হয়। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে ২০১৯ সালে স্বৈরশাসক ওমর আল-বশির সুদান আর্মির ইন্সপেক্টর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেন সুদানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানকে। এবং নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার দুই মাস পরেই আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান জেনারেল মো. হামদান দাগালোর সঙ্গে জোট বেঁধে ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন। বশির যেহেতু সেনা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে একজন শাসককে উচ্ছেদ করেছেন সেহেতু এই সত্যটুকু তিনি বেশ ভালোই বুঝতে পারছিলেন যে, কালক্রমে তিনি নিজেই এমন হস্তক্ষেপের শিকার হতে পারেন। যে কারণে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স হিসেবে তিনি সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানের পাশাপাশি রাখেন জেনারেল মো. হামদান দাগালোকে। সময়ের ব্যবধানে এই দাগালো হয়ে ওঠেন তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। এবং তাকেই কাছের মানুষ বানানোর উদ্দেশ্য একটাই- যদি সামরিক বাহিনী বশিরকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে চায়ও আরএসএফ যেন তখন বর্ম হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এই সময়কালে বশিরের অগোচরে আবার দাগালো আর বুরহানের মধ্যে গোপন ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুজনে মিলে ততদিনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সুদানের বেশ কিছু অপারেশনে। এই দুজন মিলেই পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল স্বৈরশাসক ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছেন। এবং এর পর থেকেই ক্ষমতার দখল নিয়ে দুজনের রেষারেষি শুরু হয়।

মহাকাশ থেকে ধরা পড়েছে গণহত্যার চিত্র

সুদানের পশ্চিম দারফুর অঞ্চলের এল-ফাশের শহরে আধাসামরিক বাহিনী আরএসএফের ভয়াবহ গণহত্যার প্রমাণ এখন আর শুধু প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে সীমাবদ্ধ নয়। কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহের (Satellite) ছবিতেও ধরা পড়েছে এই নৃশংসতার মর্মান্তিক চিত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাব (HRL) স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আরএসএফ যখন উত্তর দারফুরে সেনাবাহিনীর শেষ শক্ত ঘাঁটি এল-ফাশের দখল করে নেয়, তখন সেখানে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।

মূল তথ্য ও প্রমাণ

রক্তের দাগ ও লাশের স্তূপ : স্যাটেলাইট চিত্রে মাটির ওপর লালচে রঙের ছোপ ছোপ দাগ দেখা গেছে, যা বিশ্লেষকরা ‘রক্তে ভেজা মাটি’ বলে মনে করছেন। এ ছাড়াও ছবিতে মানবদেহের আকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বস্তুর গুচ্ছ (clusters of objects) স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা লাশের স্তূপের ইঙ্গিত বহন করে। গবেষকরা বলছেন, আগে তোলা কোনো ছবিতে এ ধরনের বস্তু বা মাটির রং পরিবর্তন দেখা যায়নি।

(সূত্র : ইয়েল ইউনিভার্সিটি এইচআরএল, এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেসের ছবি বিশ্লেষণ)

জাতিগত নির্মূলের প্রমাণ : ইয়েল ল্যাব তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এল-ফাশের শহরটিতে ‘জাতিগত নির্মূলের একটি পদ্ধতিগত ও ইচ্ছাকৃত প্রক্রিয়া’ চলছে বলে প্রতীয়মান হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনারব জনগোষ্ঠী যেমন- ফুর, জাগাওয়া ও বেরতি সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ও তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে। এর মধ্যে ‘ঘরে ঘরে তল্লাশি অভিযান’ চালানোর অভিযোগও রয়েছে।

সামরিক উপস্থিতির স্থান : স্যাটেলাইট চিত্রে এল-ফাশেরের দারাজা ওউলা (Daraja Oula) এলাকায় আরএসএফের সামরিক যান কৌশলগত অবস্থানে দেখা গেছে, যেখানে বেসামরিক মানুষ আশ্রয় খুঁজছিল। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, শহরের প্রতিরক্ষাপ্রাচীরের (Defensive Berm) কাছে এসব লাশের গুচ্ছ দেখা গেছে, যা পালিয়ে যাওয়া বেসামরিক লোকদের হত্যা করার খবরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

হত্যাযজ্ঞ চলছেই : আরএসএফ শহরটি দখল করার পরও হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে বলে নতুন স্যাটেলাইট ছবিতে প্রমাণ মিলেছে। এই ছবিগুলোতে দেখা যাচ্ছে, মৃতদেহের স্তূপ বাড়ছে এবং পুরনো দেহগুলোও সেখানেই পড়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রে দেহের আকারের বস্তুগুলো সরাতে দেখা গেছে, যা ‘দেহ অপসারণের’ ইঙ্গিত দিতে পারে।

বিপর্যস্ত মানুষ : জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) জানিয়েছে, ১৮ মাস অবরোধের পর আরএসএফ শহর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর গত সপ্তাহান্তে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ বাঁচাতে এল-ফাশের ছেড়ে পালিয়েছে। এখনও প্রায় দেড় লাখ মানুষ সেখানে অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইয়েল ল্যাবের নির্বাহী পরিচালক নাথানিয়েল রেমন্ড এই সহিংসতার মাত্রা তুলনা করে বলেছেন, ‘আমরা এখন রুয়ান্ডার গণহত্যার প্রথম ২৪ ঘণ্টার পরিস্থিতিতে আছি। সহিংসতার ঢেউ সবে শুরু হয়েছে।’ এই ভয়াবহ চিত্র স্পষ্ট করে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্রুত পদক্ষেপ ছাড়া সুদানের এই মানবিক বিপর্যয় থামানো অসম্ভব।

হাসপাতালেও গণহত্যা

সুদানের এল-ফাশের দখল করার কয়েক দিনের মধ্যেই র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস মিলিশিয়া বাহিনী শহরের প্রধান হাসপাতালে শত শত বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে বলে খবর দিয়েছেন জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান। তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস বলেছেন, হাসপাতালে ৪৬০ জনকে হত্যার ঘটনায় জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থা বিস্মিত ও গভীরভাবে শোকাহত। এর আগে সুদান ডক্টরস নেটওয়ার্ক বলেছিল, আরএসএফ যোদ্ধারা মঙ্গলবার সৌদি হাসপাতালে যাকে পেয়েছে- রোগী, তাদের আত্মীয়স্বজন এবং উপস্থিত অন্য সবাইকে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে।

সংগঠনটি নিহতের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা না জানিয়ে বলেছে, শহরের চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোকে ‘মানব কসাইখানায়’ পরিণত করা হয়েছে। নেটওয়ার্কটি অভিযোগ করেছে, আরএসএফ চারজন ডাক্তার, একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন নার্সকে অপহরণ করেছে এবং তাদের মুক্তির জন্য দেড় লাখ ডলারের বেশি মুক্তিপণ দাবি করছে।

যেভাবে বন্ধ হতে পারে এই হত্যাযজ্ঞ

সুদানের এই সংঘাত শুধু দুই জেনারেলের লড়াই নয়; এটি সুদানের জনগণের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি জটিল আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষমতার খেলা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও জোরালো ও ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ ছাড়া এই ‘বিস্মৃত গণহত্যা’ বন্ধ করা কঠিন, যেখানে প্রতিনিয়ত বেসামরিক মানুষের জীবন পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

আরব দেশগুলোর প্রভাবের কারণ

সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধকে প্রায়শই দুই জেনারেলের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখা হলেও এর গভীরে রয়েছে আঞ্চলিক শক্তিধর আরব দেশগুলোর বিশাল ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ। সুদান দীর্ঘদিন ধরেই সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশরের মতো দেশগুলোর প্রভাব বিস্তারের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই দেশগুলোর পাল্টাপাল্টি সমর্থন ও হস্তক্ষেপের কারণেই সংঘাতটি এক জটিল আঞ্চলিক ছায়াযুদ্ধের রূপ নিয়েছে। এখানে সুদানে আরব দেশগুলোর প্রভাবের প্রধান কারণগুলো তুলে ধরা হলো :

ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থান : লোহিত সাগরের নিয়ন্ত্রণ : সুদান লোহিত সাগরের উপকূলে অবস্থিত। এই জলপথটি এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরব দেশগুলো, বিশেষ করে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এবং সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়।

স্বার্থ : লোহিত সাগরের বন্দরগুলোতে নিজেদের নৌ-ঘাঁটি বা সামরিক সুবিধা তৈরি করা তাদের প্রধান লক্ষ্য। সুদানের সেনাবাহিনীর (SAF) প্রধান বুরহান তার সদর দপ্তর লোহিত সাগরের তীরবর্তী পোর্ট সুদানে সরিয়েছেন, যা এই গুরুত্বকে তুলে ধরে।

নীলনদের নিয়ন্ত্রণ : নীলনদের গতিপথ সুদান হয়ে মিশরে প্রবেশ করেছে। মিশরের জন্য নীলনদের পানি জীবনের প্রতীক। তাই সুদান তার প্রতিবেশী দেশ মিশরের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল।

স্বার্থ : মিশর তার সামরিক প্রধান জেনারেল বুরহানের নেতৃত্বাধীন SAF-কে সমর্থন করে, যাতে তারা তাদের সীমান্তের নিরাপত্তা এবং নীলনদের জলসম্পদের ওপর যেকোনো হুমকি এড়াতে পারে।

বিশাল অর্থনৈতিক সম্পদ

স্বর্ণের খনি পাচার : সুদান আফ্রিকার অন্যতম প্রধান স্বর্ণ উৎপাদনকারী দেশ। RSF প্রধান জেনারেল দাগালো তার আধাসামরিক বাহিনীর মাধ্যমে সুদানের কিছু সোনার খনি নিয়ন্ত্রণ করেন।

স্বার্থ : অভিযোগ রয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত RSF-কে সমর্থন দেয়, কারণ হেমেদতি এই সোনা ইউএইর মাধ্যমে পাচার করেন, যা তার যুদ্ধের অর্থের অন্যতম প্রধান উৎস।

কৃষি ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগ : সুদান কৃষিজমি এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ।

স্বার্থ : সৌদি আরব ও UAE দীর্ঘদিন ধরে সুদানের অবকাঠামো, খনি ও কৃষি খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে।

আদর্শগত প্রভাব ও ইসলামপন্থি নিয়ন্ত্রণ

ইসলামি শাসনের আশঙ্কা দূর করা : উপসাগরীয় আরব দেশগুলো (সৌদি আরব ও আরব আমিরাত) সুদানে ইসলামপন্থি কোনো সরকার ক্ষমতায় আসুক তা একেবারেই চায় না। ওমর আল-বশিরের পতনের পর গণতন্ত্রের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তাতে ইসলামপন্থি দলগুলোও প্রভাব বিস্তার করতে পারত।

স্বার্থ : এই দুই দেশ সুদানের সামরিক নেতাদের সমর্থন করে, যাতে তারা পশ্চিমা সমর্থিত গণতন্ত্র বা ইসলামপন্থি শাসন থেকে দেশকে দূরে রাখতে পারে। তারা মনে করে, সুদানের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা তাদের নিজেদেরই দায়িত্ব।

আঞ্চলিক ক্ষমতা বিস্তারের প্রতিযোগিতা

ছায়াযুদ্ধে অংশ নেওয়া : সুদানের সংঘাত মূলত আরব অঞ্চলের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে একটি আঞ্চলিক ‘ছায়াযুদ্ধে’ পরিণত হয়েছে।

আরব শক্তিধররা কে কোন পক্ষে

সংযুক্ত আরব আমিরাত : RSF প্রধান হেমেদতিকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সমর্থন করার অভিযোগ রয়েছে, কারণ হেমেদতি আগে ইয়েমেনে UAE-এর পক্ষে ভাড়াটে সেনা পাঠিয়েছিলেন এবং স্বর্ণের ব্যবসার কারণে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

মিশর ও সৌদি আরব : তারা প্রধানত সুদানের সেনাবাহিনীর (SAF) প্রধান জেনারেল বুরহানকে সমর্থন করে।