অবৈধ সিগারেট বাণিজ্যের ‘হাব’ রিয়াজউদ্দিন বাজার!
চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্ততম এলাকা নিউমার্কেটের কাছেই রেলওয়ে স্টেশন। ওই এলাকায় দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ফেরি করে পান-সিগারেট বিক্রি করছেন হাশেম মিয়া। তার ছোট্ট কাঠের বাক্সে দেশি ব্র্যান্ডের পাশাপাশি চোখে পড়ে ‘ওরি’ ও ‘মণ্ড’সহ নানা বিদেশি সিগারেট। শুধু হাশেম মিয়াই নন, এভাবে শহরের বিভিন্ন মোড়ে ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে বিদেশি সিগারেট।
শহরের একাধিক খুচরা সিগারেট বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব সিগারেটের বেশিরভাগ চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও সীমান্তপথে অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করছে। এরপর সরাসরি চলে যায় চট্টগ্রামের অন্যতম পাইকারি বাণিজ্যিক কেন্দ্র রিয়াজউদ্দিন বাজারে- যা এখন অবৈধ সিগারেট ব্যবসার ‘হাব’ হিসেবে পরিচিত। খুচরা বিক্রেতারাও সেখান থেকে কম দামে এসব সিগারেট সংগ্রহ করে বিক্রি করেন।
রিয়াজউদ্দিন বাজারে সরেজমিনে দেখা গেছে, ভেতরের কয়েকটি গলিতে নানা ধরনের সিগারেটের ছোট ছোট দোকান সারি সারি সাজানো। এসব দোকান থেকেই মূলত চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা ও দেশের অন্যান্য জেলায় সিগারেট সরবরাহ করা হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে খুচরা বিক্রেতারা এসে এসব দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে যাচ্ছেন। ওরি, মণ্ড, নোভা থেকে শুরু করে প্রায় সব বিদেশি ব্র্যান্ডের সিগারেট সেখানে মজুত রয়েছে।
প্রতিবেদক ক্রেতা সেজে কয়েকটি দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলেন। তারা জানান, এখানে সব ধরনের বিদেশি সিগারেট পাওয়া যায়। এসব সিগারেটের চালান আসে দুবাই থেকে। বিদেশি ব্র্যান্ডের পাশাপাশি দেশীয় তৈরি সিগারেটও পাওয়া যায়। দামের পার্থক্য রয়েছে। তারা ফোনে অর্ডার নিলে দেশের যেকোনো জায়গায় কুরিয়ারের মাধ্যমে সিগারেট পাঠিয়ে দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই বাজারের শতাধিক দোকানে প্রতিদিন কোটি টাকার সিগারেট বেচাকেনা হয়। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে প্রতি বছর সরকার শত শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
শুধু বিদেশি নয়, বাজারটি ভরপুর দেশীয় নকল সিগারেটেও। চট্টগ্রাম শহর ও আশপাশের কয়েকটি উপজেলায়, বিশেষ করে কক্সবাজারের মহেশখালীতে বেশ কিছু কারখানায় অবৈধভাবে সিগারেট ও নকল ব্যান্ডরোল তৈরি করা হয়। সেগুলো বিভিন্ন সিগারেটের প্যাকেটে লাগিয়ে বিক্রির জন্য পাঠানো হয় রিয়াজউদ্দিন বাজারে, সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
একটি চক্র বৈধ সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহৃত করস্ট্যাম্প (ব্যান্ডরোল) খুলে তা অবৈধ উৎপাদনকারীদের কাছে বিক্রি করছেন কিছু তামাক বিক্রেতা। পরে এসব ব্যান্ডরোল পুনর্ব্যবহার করে তারা পণ্যকে করপরিশোধিত বলে উপস্থাপন করছে। ফলে কর না দিয়েই বাজারে সিগারেট ছাড়ছে। অথচ প্যাকেটে ব্যান্ডরোল থাকায় সাধারণ ক্রেতারা সেটিকে বৈধ পণ্য ভেবে নিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রিয়াজউদ্দিন বাজার ছাড়াও শহরের খাতুনগঞ্জ ও চকবাজার থেকেও প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বিদেশি ও নকল দেশীয় সিগারেট পাইকারি ও খুচরা বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। চট্টগ্রাম বিদেশি অবৈধ সিগারেটের প্রবেশদ্বার হলেও, এখন এটি দেশের অন্যতম জাতীয় সরবরাহকেন্দ্র হিসেবেও কাজ করছে।
খুচরা বিক্রেতারা জানান, এসব সিগারেট বিক্রি করলে লাভ বেশি হয় এবং যেহেতু দাম সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম ৬০ টাকার চেয়ে কম, তাই ক্রেতারাও এগুলো কিনতে আগ্রহী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিক্রেতা বলেন, আমি প্রতি প্যাকেট ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি করে মুনাফা পাই, আর খালি প্যাকেট ফেরত দিলে কোম্পানি আমাকে অতিরিক্ত ৫ টাকা দেয়।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে কসমেটিকস, প্লাস্টিক দ্রব্য, রিবন পেপার এমনকি কমলালেবুর ঘোষণার আড়ালে কোটি টাকার সিগারেট আনা হয়।
গত ২১ আগস্ট বন্দরে ১৩৭ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির একটি চালান ধরা পড়ে—‘কাগজের চালান’ দেখিয়ে আসলে আনা হয়েছিল সিগারেট পেপার। এর আগে ২২ মে ‘কমলালেবু’ হিসেবে ঘোষিত একটি কনটেইনার থেকে ১ কোটি ২৫ লাখ স্টিক বিদেশি সিগারেট জব্দ করে কাস্টমস, যেখানে প্রায় ৩০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা ছিল।
গত বছরের অক্টোবরে হালিশহর ও নয়াবাজারে অভিযানে ভুয়া ব্যান্ডরোল ও সিগারেট পেপার জব্দ করা হয়। ২০২১ সালে ১৫ মিলিয়ন স্টিক সিগারেট জব্দ হলেও চলতি বছর তা বেড়ে ৫৫ মিলিয়নে পৌঁছেছে।
এদিকে, ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকার মন্ড সিগারেট আটক করে কাস্টমস গোয়েন্দারা। এর দুই মাস আগে একই বিমানবন্দর থেকে প্লাটিনাম সিগারেটের চালান ধরা পড়ে, যেটির মাধ্যমে ৬ লাখ টাকার শুল্ক ফাঁকি রোধ হয়।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বন্দর জোনের সহকারী কমিশনার (গোয়েন্দা) ও সিএমপির জনসংযোগ কর্মকর্তা আমিনুর রশিদ বলেন, রিয়াজউদ্দিন বাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা, এটির জন্য কোতোয়ালি থানাকে বিশেষভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অবৈধ সিগারেটের বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। সামনে অভিযান আরও জোরদার করা হবে। আপনার থেকে পাওয়া তথ্যও যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রামের যুগ্ম পরিচালক চপল চাকমা বলেন, আমরা বন্দরের কার্যক্রমে সক্রিয় আছি। তারপরও নানা কৌশলে কিছু পণ্য ঢুকে যায়। সর্বোচ্চ যাচাইয়ের চেষ্টা করি। বন্দরের বাইরে শুল্ক গোয়েন্দা টিমও মাঠে কাজ করছে। বন্দরের ভেতরের বিষয়ে কেউ তথ্য দিলে তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করি।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল করিম বলেন, আমরা সজাগ আছি। এসব বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশ নিয়মিত কাজ করছে। বাজারে অবৈধ সিগারেট বিক্রির বিষয়ে প্রতিনিয়ত নজরদারি চালাচ্ছি।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. ইব্রাহিম খলিল বলেন, আমাদের নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স টিম নিয়মিত কাজ করছে। অতীতে এরকম ঘটনায় কয়েকজন ধরা পড়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা নিয়মিত মিটিং করি ও যাত্রীদের সতর্ক করি। বিমানবন্দরের কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য থাকলে সেটি আমাদের দেবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, শুধু অভিযানে সমস্যার সমাধান হবে না। বন্দরে স্বচ্ছ স্ক্যানিং ও ট্রান্সশিপমেন্টের ওপর কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। রিয়াজউদ্দিন বাজারের মতো পাইকারি আড়তেও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ জরুরি। এখানে একটি চোরাকারবারি চক্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। যতক্ষণ না সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা হবে, ততক্ষণ এই প্রবণতা কমবে না-বরং আরও বাড়বে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হক জানিয়েছেন, অবৈধ সিগারেট শুধু রাজস্ব ক্ষতির কারণ নয়, এটি জনস্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি। এসব পণ্যে কোনো মাননিয়ন্ত্রণ নেই। আমরা ভ্যাট ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাব এবং সমন্বিত অভিযানের মাধ্যমে এই প্রবণতা রোধে সক্রিয়ভাবে কাজ করব।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সিগারেট খাতে করহার বৃদ্ধি করা হলেও এর উল্টো প্রভাব পড়েছে। উচ্চ কর ও দামের কারণে আকাক্সিক্ষত রাজস্ব তো সরকার পাচ্ছেই না। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈধ ব্র্যান্ডের বিক্রি কমেছে, আর বাজার দখল করছে সস্তা অবৈধ ব্র্যান্ড। ফলে রাজস্ব আয়েও যে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা বাড়তেই থাকবে বলে আশঙ্কা করা যায়।
সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক গবেষণা বলেছে, বর্তমানে অবৈধ সিগারেট জাতীয় বাজারের প্রায় ১৩ দশমিক ১ শতাংশ দখল করে আছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি মাসে প্রায় ৮৩২ মিলিয়ন স্টিক অবৈধ সিগারেট বাজারে প্রবেশ করছে, যার ফলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে।