স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে অবহেলা করলেই বিপদ

ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী
০২ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২১
শেয়ার :
স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে অবহেলা করলেই বিপদ

স্ট্রোক মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত গুরুতর ব্যাধি এবং মানবজীবনে ভয়াবহ দুর্দশা ডেকে আনে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার কারণে স্ট্রোকে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। স্ট্রোকের মূল কারণ মস্তিষ্কের রক্তনালির ক্ষতি। মস্তিষ্ক অসংখ্য সংবেদনশীল কোষ দিয়ে গঠিত। এগুলোর সঠিক কার্যকারিতার জন্য অবিরাম রক্তসঞ্চালন প্রয়োজন। অক্সিজেন বা শর্করার সামান্য ঘাটতিতে এসব কোষ নষ্ট হতে শুরু করে। দুর্ঘটনা ছাড়া অন্য কোনো কারণে মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্তসঞ্চালন ২৪ ঘণ্টার জন্য ব্যাহত থাকলে বা এর মধ্যে রোগী মারা গেলে, সেটিই ব্রেইন স্ট্রোক হিসেবে বিবেচিত হয়।

স্ট্রোকের অন্যতম লক্ষণ হলো পক্ষাঘাত। সাধারণত শরীরের একপাশ অবশ হয়ে যায়, অনুভূতিশক্তি হারায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ধরন ও মাত্রার ওপর নির্ভর করে অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুও হতে পারে। মস্তিষ্কের যে অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে অংশের নিয়ন্ত্রণাধীন অঙ্গগুলো কার্যকারিতা হারায়। যেমন- মস্তিষ্কের ডান পাশ আক্রান্ত হলে শরীরের বাম দিক অচল হয়ে পড়ে এবং বিপরীত অবস্থাতেও একই ঘটনা ঘটে। স্ট্রোকের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে শরীরের একপাশের দুর্বলতা বা অসাড়তা, মাথাব্যথা, বমি, কথা জড়ানো, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া, মুখমণ্ডলে ব্যথা বা বিকৃতি, ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি। এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

স্ট্রোকের চিকিৎসায় সময়ই মূল চাবিকাঠি; যত দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে আনা যায়, ততই বাঁচার সম্ভাবনা বাড়ে। প্রভাবের ধরন অনুযায়ী স্ট্রোককে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ইসকেমিক ও হেমোরেজিক স্ট্রোক। ইসকেমিক স্ট্রোকে মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধে বা জমাট রক্ত মস্তিষ্কে পৌঁছে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত করে। এতে মৃত্যুহার তুলনামূলক কম হলেও দীর্ঘমেয়াদি পঙ্গুত্বের আশঙ্কা থাকে। হেমোরেজিক স্ট্রোকে রক্তনালি ফেটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। ফলে রোগী অচেতন হয়ে পড়ে বা উচ্চ রক্তচাপে দুর্বল হয়ে যায়। এতে মৃত্যুহার বেশি, তবে যারা প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠতে পারেন, তাদের পুনরায় স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলক কম থাকে।

স্ট্রোকের পর দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আক্রান্ত ব্যক্তিকে যদি তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আনা যায়, তাহলে থ্রম্বোলাইসিস (ইনজেকশনের মাধ্যমে জমাট রক্ত গলিয়ে দেওয়া) বা থ্রম্বেকটমি (স্টেন্টের মাধ্যমে রক্ত অপসারণ) করা সম্ভব, যা রোগীর প্রাণরক্ষা ও পঙ্গুত্ব রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। সাধারণত ৫৫ বছরের ঊর্ধ্বে ব্যক্তিদের স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। পুরুষদের তুলনায় এ ঝুঁকি কিছুটা বেশি দেখা যায়। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্থূলতা, পারিবারিক ইতিহাস, ধূমপান, মদ্যপান, হৃদযন্ত্রের সংক্রমণ বা ব্যথা, হরমোন থেরাপি এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির ব্যবহার স্ট্রোকের আশঙ্কা বাড়ায়।

রোগীর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দ্রুত কৃত্রিমভাবে শ্বাস দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। প্রয়োজনে মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দেওয়া যেতে পারে। বমি হলে মাথা এক পাশে কাত করে রাখতে হবে, যাতে শ্বাসনালি বন্ধ না হয়ে যায়। এ সময় কোনোভাবেই রোগীকে কঠিন বা তরল খাবার দেওয়া যাবে না। অজ্ঞান রোগীর ক্ষেত্রে শ্বাস, রক্তসঞ্চালন ও শরীরের অন্যান্য কার্যক্রম মনিটরিং শুরু করা জরুরি। রোগীকে এক পাশে কাত করে শুইয়ে দিতে হবে এবং মূত্রত্যাগে অসুবিধা হলে ক্যাথেটারের সাহায্য নিতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগ

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতাল

চেম্বার : পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার-২, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, ঢাকা

হটলাইন : ০১৮৮৬১৮০৬৫৯, ০১৯২৭০৭৮৭৬৬