খুলেছে সেন্টমার্টিনের দ্বার, তবে ছাড়েনি জাহাজ
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন শনিবার (১ নভেম্বর) থেকে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো জাহাজ ছাড়েনি দ্বীপের উদ্দেশে। রাতযাপনের অনুমতি না থাকায় পর্যটকদের আগ্রহ কমে যাওয়ায় যাত্রী সংকটে পড়ে জাহাজ ছাড়েননি মালিকরা। এমনকি সেখানে কোনো পর্যটকও যায়নি।
শনিবার (১ নভেম্বর) সকালে কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছড়ার বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়।
দেখা যায়, সেন্টমার্টিন যাওয়ার কোনো জাহাজ নোঙর করেনি। একটিমাত্র টাগশিপে যাত্রী উঠে রওনা দিচ্ছে মহেশখালী দ্বীপে। সেন্টমার্টিন যাবে এ রকম কারও দেখাও মেলেনি। তবে পর্যটন এলাকায় অবস্থানরত কিছু পর্যটকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
খুলনার খালিশপুর থেকে আসা পর্যটক রফিক আল ইসলাম বলেন,‘সেন্টমার্টিন এমন এক জায়গা, যেখানে সময় থেমে যায়। কিন্তু দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসার বাধ্যবাধকতায় সেই স্বপ্নময় সময় কাটানোর সুযোগটা হারিয়ে যাচ্ছে।’
কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে আসা জেমি ইসলাম বলেন, ‘সেন্টমার্টিন মানেই নিরিবিলি একটুখানি বিশ্রাম আর সমুদ্রের সান্নিধ্য। কিন্তু দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসার নিয়মে সেই প্রশান্তির অনুভূতিটা হারিয়ে যাচ্ছে।’
ঢাকার মালিবাগ থেকে আসা সমীর দেওয়ান বলেন, ‘দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে অন্তত এক রাত থাকা দরকার। এখনকার নিয়মে দিনে ঘুরে ফিরে আসতে হয়, এতে সেন্টমার্টিন ভ্রমণের আসল আনন্দটা আর পাওয়া যায় না।’
জাহাজ মালিকরা জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাস নির্দিষ্ট শর্তে পর্যটক যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে নভেম্বরে কেবল দিনের বেলায় ঘুরে ফিরে আসার নিয়মে অনেক ভ্রমণপিপাসুই সেন্টমার্টিন ভ্রমণ বাতিল করেছেন। ফলে বাধ্য হয়ে নভেম্বরে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন,‘আজ থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার অনুমতি থাকলেও আমরা জাহাজ ছাড়িনি। কারণ দিনে গিয়ে দিনে চলে আসলে পর্যটকরা সেন্টমার্টিন যাবেন না। এটা নিশ্চিত হওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিদওয়ানা হাসান নিজে একবার এসে যেন সেন্টমার্টিন এবং আমাদের অবস্থানটা দেখে যান। তিনি সশরীরে এসে দেখলে আমাদের কষ্টটা বুঝতে পারবেন আশা করি।’
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় প্রায় নয় মাস পর দ্বীপটি উন্মুক্ত হলেও পুরো নভেম্বর মাসে পর্যটকদের দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসতে হবে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক দ্বীপে রাত্রিযাপনের সুযোগ পাবেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিআইডব্লিউটিএ পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কোনো নৌ যানকে সেন্টমার্টিনে যাতায়াতের অনুমতি দিতে পারবে না। টিকিট ক্রয় করতে হবে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের অনুমোদিত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে। প্রতিটি টিকিটে থাকবে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড; কিউআর কোড ছাড়া টিকিট নকল হিসেবে বিবেচিত হবে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, নভেম্বর মাসে কেবল দিনের বেলায় ভ্রমণের অনুমতি থাকবে, রাতে থাকা নিষিদ্ধ। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে সীমিত পরিসরে রাত্রিযাপন সম্ভব হবে, আর ফেব্রুয়ারিতে সম্পূর্ণভাবে পর্যটক যাতায়াত বন্ধ থাকবে। প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটকই দ্বীপে ভ্রমণ করতে পারবেন।
সেন্টমার্টিনের নাজুক পরিবেশ রক্ষায় একাধিক বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। দ্বীপে রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, উচ্চ শব্দ সৃষ্টি, বারবিকিউ পার্টি, কেয়া বনে প্রবেশ বা ফল সংগ্রহ ও বিক্রয়, কাছিম-পাখি-প্রবালসহ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এ ছাড়া সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইক বা অন্য কোনো মোটরচালিত যান চলবে না। নিষিদ্ধ পলিথিন বহন করা যাবে না এবং একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকজাত সামগ্রী- যেমন চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক চামচ, স্ট্র, সাবান ও শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, ৫০০ ও ১০০০ মিলিলিটারের বোতল-বহন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পর্যটকদের নিজস্ব পানির ফ্লাস্ক সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সেন্টমার্টিন বাজার সমিতির সভাপতি আব্দুর রহমান বলেন, ‘সেন্টমার্টিন কক্সবাজার শহর থেকে অনেক দূরে। আসতে-যেতে দিনের পুরো সময়টা চলে যায়। তাই রাত্রিযাপন ছাড়া পর্যটক এখানে আসবে না। বর্তমানে আমরা ক্ষতির মুখে জীবনযাপন করছি।’
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ‘দ্বীপের অর্থনীতি এখন প্রায় পঙ্গু। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্রলার, দোকান সবখানেই নেমে এসেছে অচলাবস্থা। স্থানীয় মানুষের জীবিকা পুরোপুরি পর্যটননির্ভর। এখন তারা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। আমরা দ্বীপের পরিবেশ রক্ষার পক্ষে, তবে জীবিকার দিকটাও যেন সরকার বিবেচনায় নেয় এটাই আমাদের মিনতি।’
টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘দ্বীপে মোটরযান নিষিদ্ধ ও পর্যটক নিয়ন্ত্রণে কড়া নজরদারি থাকবে। দ্বীপে পর্যটক পরিবহনের জন্য নৌযানগুলোকে অনুমতি নিতে হবে। স্থানীয়দের জন্য অনুমতির দরকার নেই। পরিবেশ রক্ষায় এ পদক্ষেপ জরুরি।’
আমাদের সময়/এএস