উৎপাদনের সুফল মিলছে কম
সবজির বাড়তি দামে দীর্ঘ সময় ধরে নাস্তানাবুদ ভোক্তা। চলতি অর্থবছর শাকসবজির উৎপাদন সন্তোষজনক। কিন্তু বাজারে তার সুফল মিলছে কম। ত্রুটিযুক্ত বাজার ও বিপণনব্যবস্থা এর পেছনে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, ফড়িয়া থেকে আড়তদার, আড়তদার থেকে পাইকারি, পাইকারি থেকে খুচরাÑ এভাবেই পণ্যের দাম অতিরিক্ত বাড়ে। তাই হাত বদলের সংখ্যা কমানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে সবজির চাষের মৌসুমগুলোর মধ্যে অন্যতম গ্রীষ্মকালীন খরিপ-১। এই সময়ে পটোল, করলা, ঢেঁড়স, শসা, ঝিঙ্গা, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদি চাষ করা হয়। এর পর রয়েছে বর্ষাকালীন খরিপ-২ মৌসুম। এ সময়েও গ্রীষ্মকালীন কিছু সবজি চাষাবাদ হয়ে থাকে, তবে কম পরিমাণে। এর পর রয়েছে শীতকালীন রবি মৌসুম। এ মৌসুমে অনেক প্রকার সবজির চাষ হয়। এর মধ্যে রয়েছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, গাজর, শিম, পালংশাক, মুলা, শালগম, লেটুস, ক্যাপসিকাম, ওলকপি ইত্যাদি। এ ছাড়া বারোমাসি সবজিও রয়েছে। কিছু সবজি আছে যা সারা বছর ধরে চাষ করা হয়; যেমন- বেগুন, মরিচ, করলা, শসা ইত্যাদি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের খরিপ-১ মৌসুমে ক্ষয়ক্ষতি বাদ দিয়ে গ্রীষ্মকালীন সবজির অর্জিত জমির পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৭১৮ লাখ হেক্টর। প্রতি হেক্টরে গড় ফলন ছিল ১৯ দশমিক শূন্য ৭ মে. টন। এ মৌসুমে সবজির উৎপাদন ছিল ৭০ দশমিক ৯৫৫ লাখ মে. টন। এর পর খরিপ-২
মৌসুমে শাকসবজির অর্জিত জমির পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৯৭২ লাখ হেক্টর। মৌসুমের তুলনায় গড় ফলন সন্তোষজনক ছিল; হেক্টরপ্রতি ১৭ দশমিক ৬৫ মে. টন। এ মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে ১৯ দশমিক ৬৬৮ লাখ মে. টন সবজি। এমন উৎপাদনের পরও বাজারে বাড়তি দামে শাকসবজি কিনে খেতে হয়েছে ভোক্তাদের। আগামী রবি মৌসুমেও সবজির ভালো উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তা ছাড়া এবার আগাম সবজির চাষও ভালো হয়েছে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রবি মৌসুমের আবাদকৃত জমির পরিমাণ এখনও প্রকাশ করেনি। তবে এবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৩৫ লাখ হেক্টর জমি এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪৯ দশমিক ৪০৮ মে. টন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে রবি মৌসুমে সবজির ভালো উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারের ত্রুটিগুলো দূর করা না গেলে খরিপ-১ ও ২-এর মতো রবিতেও ভালো উৎপাদনের সুফল ভোক্তারা পুরোপুরি ভোগ করতে পারবেন না। অতিরিক্ত দামেই কিনে খেতে হবে তাদের।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের বিদ্যমান বাজার ও বিপণনব্যবস্থায় বড় সমস্যাই হলো হাতবদলের সংখ্যা অনেক বেশি এবং এর মধ্য দিয়েই পণ্যের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যায়। এই হাত বদলের সংখ্যা কমাতে হবে। কৃষক ও ভোক্তাদের মধ্যকার দূরত্বটা কমাতে হবে। কৃষকের বাজার তৈরি করা যেতে পারে। বাজারব্যবস্থাকে কৃষকের অনুকূলে নিতে পারলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই লাভবান হবেন। তিনি আরও বলেন, আমরা দেখতে পাই কৃষকপর্যায়ে সবজির দাম কম থাকলেও, রাজধানীর খুচরা বাজারে অনেক বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা অনৈতিকভাবে বেশি মুনাফা করে নিচ্ছেন। অথচ কৃষকরা ভালো দাম পাচ্ছেন না। কৃষকরা ভালো দাম না পেলে পরের বার তারা চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। তাই কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই যাতে লাভবান হয়, এ জন্য দক্ষ বাজারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) নতুন সভাপতি এএইচএম সফিকুজ্জামান দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্যাবের কার্যক্রম অবহিতকরণ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে রাজধানীর সবজির বাজারের অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সাবেক এ মহাপরিচালক তার অভিজ্ঞতা থেকে জানান, কারওয়ানবাজারের উত্তর গেট দিয়ে ৩০ টাকার পটোল প্রবেশ করে সেটি অন্য গেট দিয়ে পাইকারি বা খুচরা বাজারে যখন আসে, তখন দাম বেড়ে হয় ৭০ টাকা। আমরা যে সবজি ১০০ টাকায় কিনছি, সেটির ৮০ টাকা যদি কৃষক পেতেন, তা হলেও কষ্ট হতো না। কিন্তু কৃষক পাচ্ছেন ৩০ টাকা। মাঝখানে আমি ভোক্তা সেই জিনিস ১০০ টাকায় কিনছি। ওই ৭০ টাকা তো পথে পথে চলে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ হ্রাস ও বিপণনব্যবস্থা আধুনিক না করতে পারার কারণে এমন সমস্যা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
ক্যাব সভাপতি বলেন, হাতবদলের সংখ্যা কমিয়ে এনে কৃষক ও খামারিদের পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে যাতে পৌঁছাতে পারে, সে উদ্যোগ নিতে হবে। তা হলে কারওয়ানবাজারসহ রাজধানীর বাজারগুলোয় যে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য রয়েছে, সেটা ভেঙে যাবে।
এদিকে এ বছর রাজধানীর বাজারে আগাম শীতকালীন সবজি খানিকটা দেরিতে উঠেছে। অন্যান্য বছর অক্টোবর থেকে সবজির দাম নিম্নমুখী হলেও এবার নভেম্বরেও সেভাবে দাম কমছে না। যদিও চলতি সপ্তাহে দাম কিছুটা নিম্নমুখী রয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে দাম কিছুটা কমে কাঁকরোল, বরবটি, ঢ্যাঁড়স, পটোল, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, ধুন্দুলের মতো সবজির কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এখনও বেগুন, করলা, টমেটো, শসা, কাঁচামরিচের মতো কয়েক পদের দাম চড়া রয়েছে। এ ছাড়া শীতের আগাম সবজিগুলো কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। ভোক্তারা বলছেন, এখনও তরিতরকারি যে দাম রয়েছে, তা বেশিরভাগ ক্রেতার পক্ষে কিনে খাওয়া কষ্টকর।
রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. মোস্তাক আহমেদ বলেন, এখন দাম একটু কমেছে। তার পরও বেশিরভাগ সবজির কেজি ৬০-৭০ টাকা। এর মধ্যে কিছু পদের দাম এখনও নাগালের বাইরে। এটাকে স্বস্তিদায়ক বলা যায় না। সবজির দাম ৫০ টাকার নিচে নেমে আসলে আমাদের মতো সাধারণ ক্রেতাদের জন্য স্বস্তিজনক হবে।