খুনের জনপদ রাউজান

১৩ মাসে ১৭ খুন, আহত শতাধিক

রায়হান উদ্দিন, চট্টগ্রাম
৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১৯
শেয়ার :
খুনের জনপদ রাউজান

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দোকানের বেঞ্চে বসেছিলেন যুবদলকর্মী মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তখন সন্ধ্যা সবেমাত্র রাত শুরু। হঠাৎ করে তিনটি অটোরিকশা এসে থামে রাস্তার ধারে। মুহূর্তের মধ্যে নেমে আসে ১০-১২ জন অস্ত্রধারী যুবক। কিছু বোঝার আগেই তারা ইব্রাহিমের মাথার পেছনে, কোমরে ও ঊরুতে একের পর এক গুলি করতে থাকে। ইব্রাহিমের নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। খুনিরা নির্বিঘ্নে অদৃশ্য হয়ে যায় রাতের আঁধারে।

গত ২২ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার সদর ইউনিয়নের শমসেরনগরের গাজীপাড়ায় ঘটে এই হত্যাকাণ্ড। তবে ইব্রাহিম একা নন, গত বছরের ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর থেকে রাউজান পরিণত হয় রক্তাক্ত জনপদে। গণ-অভ্যুত্থানের পর এখন পর্যন্ত এখানে খুন হয়েছেন ১৭ জন। তাদের মধ্যে বিএনপির নয়জনসহ ১৩ জনই রাজনৈতিক দলের কর্মী। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ, জখম ও হামলার শিকার হয়েছেন শতাধিক মানুষ।

সর্বশেষ গত শনিবার যুবদলকর্মী আলমগীর আলমকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এর আগে ৭ অক্টোবর গুলিতে বিএনপির কর্মী আবদুল হাকিম নিহত হন। পুলিশ জানিয়েছে, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। প্রতিটি খুনের ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ মূল অপরাধীকে গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধার করতে পারছে না বলে দাবি নিহত স্বজনদের।

গুলিতে নিহত আবদুল হাকিমের বড় ভাই আবদুল হালিম গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, আমার ভাই হত্যার পর মামলা করা হলেও এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। কাউকে শনাক্ত করা হয়েছে কিনা, সেটাও আমাদের জানানো হয়নি। পুলিশ চেষ্টা করছে বলে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান (পদ স্থগিত) গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারীদের মধ্যে রাউজানে মারামারি ও খুন হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয় অধিবাসীদের। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের জন্য তারা পরস্পরকে দায়ী করেন। এর মধ্যে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দুই নেতা একই আসন থেকে মনোনয়ন চাইছেন। এ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে খুনের ঘটনা ঘটছে বলে বলা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, মূলত মাটি কাটা, খালের বৈধ ও অবৈধ বালুর মহাল দখল ও বিক্রির বিরোধ, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়সহ নানা অনিয়মের বিরোধে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এগুলোর সঙ্গে রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা নেই। একজন নেতা এসব সন্ত্রাসীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন।

গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমি রাউজানকে শান্তির জনপদ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আমার কাছে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের কোনো স্থান নেই। আমি প্রশাসনকে বলেছি, যারা রাউজানে বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করে যেন দ্রুত আইনের আওতায় আনা হয়।

রাউজান উপজেলায় অন্তত সাতটি সন্ত্রাসী বাহিনী সক্রিয়। নোয়াপাড়া এলাকায় ফজল হক, জসিম, কামাল ও জানে আলম বাহিনী, পশ্চিম গুজরায় রমজান বাহিনী এবং বাগোয়ান ইউনিয়নে মামুন ও ভূপেশ বাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই বাহিনিগুলো মাদক, চাঁদাবাজি, বালু ও মাটি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। এক বাহিনীর সঙ্গে যখন অপর বাহিনি আধিপত্যে লিপ্ত হয়, তখনই ঘটে খুনোখুনি।

জানা গেছে, এক সময় আওয়ামী লীগ দলীয় সন্ত্রাসীরা রাউজানের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করলেও বর্তমানে বিএনপির নামধারী সন্ত্রাসীরা এলাকা দখল করেছে। প্রতিটি ইউনিয়নেই এই বাহিনীর উপ-বাহিনী গড়ে তুলে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে গড়ে তুলেছে রাউজানকে।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, গুলি, হামলা ও পাল্টাপাল্টি খুন এখন রাউজানের নিত্যদিনের ঘটনা। গত ১৩ মাসে খুন হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বিএনপির সাতজন হলেনÑ সেলিম, কমর উদ্দিন, ইব্রাহিম, দিদারুল ও মানিক আবদুল্লাহ, হাকিম ও আলমগীর। আওয়ামী লীগের চারজন হলেন- আবদুল মান্নান, মুহাম্মদ ইউসুফ মিয়া, আবু তাহের ও মুহাম্মদ হাসান। এ ছাড়া জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যবসায়ীও খুন হয়েছেন।

পাল্টাপাল্টি হত্যাকাণ্ডের কারণে রাউজানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় গত ৯ মাসে থানার তিনজন ওসিকে বদলি করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের মামলায় ১৪০ জনকে আসামি করা হলেও মূল আসামিদের গ্রেপ্তার হয়নি বলে অভিযোগ নিহতদের পরিবারের।

রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিসান বিন মাজেদ বলেন, ‘রাউজানে সন্ত্রাসীদের অবস্থান ও অপরাধপ্রবণ ঝুঁঁকিপূর্ণ এলাকার গুগল ম্যাপ তৈরি করে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। সন্ত্রাসীদের কারণে রাউজানের সার্বিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) মো. রাসেল বলেন, পুলিশ অস্ত্রসহ অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করছে। মূলত অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুন হচ্ছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া তা রোধ করা কঠিন। নির্বাচনের আগে আমরা জিরো টলারেন্স। রাউজানের সব সন্ত্রাসীকে আইনের আওতায় আনতে কাজ করছি।

মুহাম্মদ কামাল নামে এক ব্যক্তির বাড়ি থেকে ১১টি বন্দুক উদ্ধার করেছে র‌্যাব। গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া ইউনিয়নে অভিযান চালিয়ে বন্দুকসহ বিপুল পরিমাণ ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করে র‌্যাব। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ১১টি বন্দুক, ২৭টি দেশি ধারালো অস্ত্র, ৮টি ক্রিকেট স্ট্যাম্প ও ১৫টি কার্তুজ। মুহাম্মদ কামাল সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান খায়েজ আহমদের ছেলে। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার তিনজনকে থানা পুলিশের মাধ্যমে আদালতে পাঠানো হয়েছে।