সনদে পরিবর্তন, অনৈক্যের আশঙ্কা
চূড়ান্ত সুপারিশ থেকে বাদ নোট অব ডিসেন্ট ।। গণভোটের সময়সূচি নির্দিষ্ট করা হয়নি ।। দলগুলোতে বাড়তে পারে প্রতিহিংসা ও অবিশ্বাস ।। যুক্ত হয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন ।। গোড়া থেকেই কাজকর্ম অনেকটা অগোছালো : অধ্যাপক মানস চৌধুরী
জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে গত মঙ্গলবার জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর আগে, গত ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে বিএনপি-জামায়াতসহ ২৪টি রাজনৈতিক দল। দুদিন পর গণফোরামও স্বাক্ষর করে। সে সময় সনদে নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ ছিল। কিন্তু সরকারের কাছে বাস্তবায়নের সুপারিশসহ জমা দেওয়া সনদের চূড়ান্ত কপিতে নোট অব ডিসেন্ট নেই। এর মধ্য দিয়ে কমিশন প্রতারণা করেছে বলে মনে করছে বিএনপি।
এ ছাড়া সাংবিধানিক সংস্কারের লক্ষ্যে যে গণভোট হবে, এর সময়কাল নিয়েও বিএনপি-জামায়াতের মতানৈক্য চরমে। অন্যদিকে সনদে এখনও স্বাক্ষর করেনি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ফলে সনদ বাস্তবায়ন, গণভোট আয়োজনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক মাঠে দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য আরও বাড়তে পারে; দেখা দিতে পারে প্রতিহিংসা ও অবিশ্বাস। এমন আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য মানস চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা বা পলিটিক্যাল উইল বলে যেটা বলা হয়, সেটাকেই সাধারণ লোকজন ‘নিয়ত’ বলে থাকে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর যে কমিশন গঠন হয়, তার নিয়তের বিষয়ে সকলের একরকম প্রত্যয় ছিল না, এখনও নেই। এটাই বাস্তবতা। তিনি বলেন, যে কোনো সনদ বা পরিপত্র বানানোর পর সংযোজন-বিয়োজন সাধারণভাবেই বিধিসিদ্ধ হতে হয়। অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে একাধিক কমিশন গঠিত হয়েছে। কিন্তু সংবিধান ও এই সনদ বিষয়ে কাজকর্ম যথাসম্ভব অগোছালো বা ক্লামজি হয়েছে, গোড়া থেকেই।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের রিকমেন্ডেশন (সুপারিশ) দিয়ে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার কাছে। প্রধান উপদেষ্টার সইও আছে সেখানে। তিনিও এই কমিশনের চেয়ারম্যান। অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে যে বিষয়গুলোর সঙ্গে আমরা একমত ছিলাম না, আমরা সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলাম। সেই নোট অব ডিসেন্টগুলো লিপিবদ্ধ করার একটা প্রতিশ্রুতি ছিল তাদের (কমিশনের)। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে আমরা লক্ষ করলামÑ তারা যখন এটা প্রকাশ করলেন, তখন সেই নোট ডিসেন্টগুলো নেই। পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা তো ঐকমত্য হতে পারে না। তাহলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনটা করা হয়েছিল কেন? আমি বলব, জনগণের সঙ্গে এটা একটা প্রতারণা; রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা। এগুলো অবিলম্বে সংশোধন করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেখানে গণভোট কখন হবে, সেটি স্পষ্ট করে বলেনি। এর মাধ্যমে গণভোটের তারিখ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ‘বল’ চলে গেছে সরকারের কোর্টে। এ বিষয়ে এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। এখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সমস্ত প্রস্তাব (সুপারিশে) দিয়েছে, সেখানে শুধু জাতিতে বিভক্তি হবে, অনৈক্য হবে এবং এখানে কোনো ঐকমত্য হবে না। এর ভিত্তিতে তারা কী অর্জন করতে চায়, আমরা জানি না। তিনি বলেন, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় দেখতে চাই। তারা যেন নিরপেক্ষ আচরণ করে এবং তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডে যেন জাতি আশ্বস্ত হতে পারে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, সংবিধানকে স্থগিত করে বা বাইপাস করে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তা কাজ করবে না। আমরা সংবিধান সংস্কার পরিষদের দাবি করেছি; সংবিধান সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু যদি ঐকমত্য না থাকে, আমরা তা জোর করে চাপিয়ে দিতে পারব না। সংবিধান বদলাতে পারলে সেটা পার্লামেন্টের মাধ্যমে হবে, জনগণের অনুমোদন নিয়ে। এমনকি বিপ্লবকামী দেশগুলোতেও নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয় এবং জনগণের সম্মতি নেওয়া হয়। তিনি বলেন, আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছি; সেখানে নোট অব ডিসেন্ট সম্পর্কেও কথা আছে। কিন্তু কমিশনের সুপারিশে নোট অব ডিসেন্টের উল্লেখ নেই। এটা কীভাবে হলোÑ কমিশন ব্যাখ্যা দেবে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
জোনায়েদ সাকি বলেন, অর্ডার ও অর্ডিন্যান্সের প্রসঙ্গেও বিভ্রান্তি আছে। তিনি বলেন, যদি ঐকমত্য ছাড়া কেউ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়, সেটা কাজ করবে না। আমরা সংবিধান সংস্কার পরিষদের প্রতি অনুরোধ তুলেছি। কিন্তু যুক্তি ও প্রক্রিয়া যদি ঐকমত্যহীন হয়, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ করার উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমনের ব্যবস্থায় সংস্কারের সুপারিশ দেওয়ার জন্য ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এ ছয় কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে তিন দফা আলোচনা করে সংবিধানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নোট অব ডিসেন্টসহ সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করা হয়। তখন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, সনদে নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ থাকবে। পরবর্তীকালে ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে তৈরি জুলাই জাতীয় সনদে ২৫টি দল ও জোট সই করেছে। তারা সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। স্বাক্ষর করার সময় নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ ছিল। এ ছাড়া বাস্তবায়ন পদ্ধতির ক্ষেত্রে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ গঠনের কথাও ছিল না। সরকারের কাছে গত ২৭ অক্টোবর দাখিল করা চূড়ান্ত কপিতে নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ করা হয়নি। পাশাপাশি সংসদের প্রথম ৯ মাস সংবিধান সংস্কার পরিষদ এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করবে বলে উল্লেখ করা হয়। সুপারিশে বলা হয়, সংসদ ব্যর্থ হলে সংস্কার প্রস্তাবগুলো সয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে। এসব প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি রয়েছে।
প্রতিবেদন উন্মুক্ত করার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনের একটি সহজবোধ্য বই প্রস্তুত করে দেশের জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে আট খণ্ডের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা। এতে কমিশনের সুপারিশ, সভা ও কার্যবিবরণীর বিস্তারিত রয়েছে। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই প্রতিবেদনের সহজবোধ্য একটি ভার্সন তৈরি করতে হবে সাধারণের জন্য। বই আকারে প্রকাশ করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়ে বুঝতে পারে এবং অন্যদেরও বোঝাতে পারে। বইটি ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই প্রকাশের আহ্বান জানান তিনি।