সময়ের চেয়ে যেভাবে এগিয়ে ছিলেন সালমান শাহ

ফয়সাল আহমেদ
৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩১
শেয়ার :
সময়ের চেয়ে যেভাবে এগিয়ে ছিলেন সালমান শাহ

‘সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক নাম সালমান শাহ। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নিজেকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মাত্র চার বছরেই চলচ্চিত্রে নির্ভরযোগ্য নামে পরিণত হয়েছিলেন। ভালো কাজের বিকল্প কিছু নেই এ কথা তার চেয়ে আর বেশি কে জানত! এটা তার সিনেমা দেখলেই বোঝা যায়। সে জন্য মৃত্যুর এত বছর পরেও তার জন্য মানুষ চোখের পানি ফেলেন।’ কথাগুলো বলেছেন বর্তমান সময়ের শীর্ষ নায়ক শাকিব খান। স্বাভাবিক কারণে প্রশ্ন আসে, সালমান শাহ কেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন? তার সঙ্গে কাজ করা একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী বলেন, তিনি এগিয়ে ছিলেন তার অভিনয় দিয়ে। ফ্যাশন, স্টাইল, রুচিশীল জীবনযাপনের জন্য ছিলেন তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা একজন। বিভিন্ন ধরনের পোশাকে ছিলেন সাবলীল।

শুধু তাই নয়, তার ব্যাকব্রাশ হেয়ারস্টাইলও ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। ব্যান্ডানা, নেপালি টুপি ও মধ্যপ্রাচ্যের রুমাল তার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পায়। সালমান শাহর সঙ্গে কাজ করা একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাতা জানিয়েছেন, সিনেমায় পোশাক নির্বাচনের ব্যাপারটা সালমান শাহর ওপর ছেড়ে দিতেন তারা। ফরমাল পরবেন নাকি ক্যাজুয়াল, সিদ্ধান্ত নিতেন সালমানই। এমনও হয়েছে, পরদিন শুটিং, আগের দিন সারা বিকাল-সন্ধ্যা সালমানের কেটেছে নিউমার্কেটের দোতলায়। যেকোনো প্রয়োজনে আউটডোরে গেলে কিংবা শুটিংয়ের জন্য দেশের বাইরে গেলে ফিরে আসার সময় তার সঙ্গে থাকত নানা ধরনের পোশাক-আশাকভর্তি ৬-৭টি লাগেজ।

সিনেমা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সালমান শাহর সাবলীল অভিনয়, শারীরিক ভাষা, চরিত্রগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে যাওয়ায় ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। তাই তিনি সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। সালমান শাহর ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ সিনেমার নির্মাতা বাদল খন্দকার বলেছিলেন, ‘তখন রাস্তায় বের হলেই চোখে পড়ত অসংখ্য তরুণের সালমান শাহ হওয়ার আকাক্সক্ষা। তরুণীদের কাছে তিনি ছিলেন স্বপ্নের নায়ক। এখনও সালমান সবার হৃদয়ে আছেন। নতুন যারা নায়ক হতে চান, তারা আদতে সালমান শাহই হতে চান।’

চলচ্চিত্র বিশ্লেষক এবং বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক জাকির হোসেন রাজু মনে করেন, “সালমান শাহ যে সময়টিতে অভিনয়ে এসেছিলেন, তখন ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে পালাবদলের সময়। ১৯৯২ সালে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন সালমান শাহ। জনপ্রিয় একটি হিন্দি সিনেমার অফিশিয়াল রিমেক ছিল ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। সিনেমাটি মুক্তির পর থেকেই চলচ্চিত্রে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন সালমান। পর্দায় তার পোশাক-পরিচ্ছদ, সংলাপ বলার ধরন, অভিনয়দক্ষতা- সবকিছু মিলিয়ে দর্শকের মনে স্থান করে নিতে সময় লাগেনি এই নায়কের।” মাত্র চার বছরের সিনেমা ক্যারিয়ারে অভিনয়জগতে নিজের এমন একটি স্থান করে নিয়েছিলেন যে, তার অভাব এখনও অনুভব করেন দর্শক, পরিচালক, প্রযোজক। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যত নায়কের আবির্ভাব ঘটেছিল তাদের মধ্যে সালমান শাহ সবচেয়ে প্রমিজিং (প্রতিশ্রুতিশীল) ছিলেন বলে উল্লেখ করেন জাকির হোসেন রাজু। তার বর্ণনায়, সালমান শাহর অভিনয়ের মধ্যে দর্শক একটা ভিন্নধারা খুঁজে পেয়েছিল। অনেকে আবার সালমান শাহর মধ্যে বলিউড নায়কদের ছায়াও খুঁজে পেয়েছিলেন।

সালমানের মধ্যে কী এমন ছিল যার জন্য তাকে আইডল হিসেবে দেখে সবাই? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় সালমানের সিনেমাগুলোতে। তার সহজাত অভিনয়দক্ষতা ও চরিত্রের ভেতরে ঢুকে গিয়ে একদম চরিত্রে মিশে যাওয়ার গুণটা ছিল প্রবল। প্রথম ছবি কেয়ামত থেকে কেয়ামত-এ তিনি এতটাই সপ্রতিভ ও সহজাত ছিলেন যে, কারও মনে হওয়ার উপায় ছিল না ওটাই ছিল তার প্রথম চলচ্চিত্র। আবার ‘বিক্ষোভ’ সিনেমায় তাকে একজন ছাত্রনেতা হিসেবে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যিনি দেশপ্রেমের চেতনায় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে থাকেন। ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ সিনেমায় তিনি সমাজের একজন প্রতিবাদী যুবকের চরিত্রে দারুণ নান্দনিক অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। ‘বিচার হবে’, ‘সুজন-সখী’ সিনেমায় গ্রামের ছেলে হিসেবেও ছিলেন বেশ সাবলীল। অসাধারণভাবে গ্রামীণ ভাষায় সংলাপ বলার ধরন দেখে কেউ বুঝতে পারবে না শহরের একজন স্মার্ট ও সুদর্শন মানুষ ছিলেন তিনি। আর রোমান্টিক সিনেমায় তার অভিনয়ের ভক্ত পুরো দেশ। একজন ভার্সেটাইল অভিনেতা বলতে যা বোঝায় সালমান শাহ ছিলেন তেমনই একজন। শাকিব খান বলেন, ‘চলচ্চিত্রের একজন অভিনেতার প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা আমি দেখি তা আমাকে ছুঁয়ে যায়। উদ্বেলিত করে। সাহস ও শক্তি জোগায়। বোধকরি, আমার মতো ইন্ডাস্ট্রির সব শিল্পী সেই ভালোবাসার স্পর্শ পান। আমরা উপলব্ধি করি- সালমানের মতো নিখুঁত, সাবলীল একজন স্টাইল আইকন তখন খুব দরকার ছিল। এখনও আছে। অন্তত পশ্চিমা আইকনিজমের কাউন্টার দেওয়ার জন্য। সালমান শাহ সেটা হয়েও উঠছিলেন। তাকে দেখে কত তরুণ যে চলচ্চিত্রে অভিনয়ে আগ্রহী হয়েছে সেটা আর না-ই বললাম।’

সালমান শাহর অভিনয়জীবন শুরু হয় বিটিভিতে, ১৯৮৫ সালে। হানিফ সংকেতের গ্রন্থনায় ‘কথার কথা’ নামক একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হতো তখন। সে অনুষ্ঠানের একটি গানে মাদকাসক্ত এক তরুণের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি, যে গানটি গেয়েছিলেন স্বয়ং হানিফ সংকেত। ১৯৮৫ সালে বিটিভির ‘আকাশ ছোঁয়া’ নাটকের মাধ্যমে তার অভিষেক হয় টিভি নাটকে। এর পরে দেয়াল (১৯৮৫), সব পাখি ঘরে ফিরে (১৯৮৫), সৈকতে সারস (১৯৮৮), নয়ন (১৯৯৫), স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬) নাটকেও অভিনয় করেন। ‘নয়ন’ নাটকটি সে বছর শ্রেষ্ঠ একক নাটক হিসেবে বাচসাস পুরস্কার লাভ করে। এ ছাড়া তিনি ১৯৯০ সালে মঈনুল আহসান সাবের রচিত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘পাথর সময়’ ও ১৯৯৪ সালে ‘ইতিকথা’ ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেন। প্রেমযুদ্ধ ও ঋণশোধ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকও করেন তিনি। মিল্ক ভিটা, জাগুয়ার কেডস, ইস্পাহানি গোল্ড, স্টার টি, কোকা-কোলা, ফানটাসহ কয়েকটি পণ্যের বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করেছেন।