‘নৌকার শ্লোগানদাতা’ বিএনপি নেতাকে দিলেন ১০ লাখ টাকার চেক!

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
২৭ অক্টোবর ২০২৫, ২২:০১
শেয়ার :
‘নৌকার শ্লোগানদাতা’ বিএনপি নেতাকে দিলেন ১০ লাখ টাকার চেক!

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার মন্দিয়াতা গ্রামের বাসিন্দা নূর কাশেম। বিএনপিকর্মী দাবি করে তিনি সুনামগঞ্জ-১ আসনের (জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা ও মধ্যনগর) বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুলকে সমাবেশে ১০ লাখ টাকার চেক দিয়েছিলেন।  

গত শনিবার (২৫ অক্টোবর) বিকেলে বিএনপির ৩১ দফার প্রচার ও ধানের শীষের পক্ষে জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনাবাজারে দলীয় সমাবেশের মঞ্চে উঠে ফুলের মালার সঙ্গে গেঁথে চেকটি কামরুজ্জামান কামরুলের গলায় দিয়েছিলেন নূর কাশেম। কামরুল সেটি হাতে নিয়ে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের দেখান।

এরপর বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপকভাবে প্রচার হয়ে যায়। একজন সাধারণ কর্মীর ১০ লাখ টাকার চেক প্রদান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। কারণ চেক প্রদানকারী নূর কাশেম ও কামরুজ্জামান কামরুলের বাড়ি একই উপজেলা তাহিরপুরে। 

এরপর নূর কাশেম দাবি করেছিলেন, তিনি বিএনপির একজন কর্মী। আবেগে পড়ে প্রিয় নেতাকে তিনি ১০ লাখ টাকার চেক দিয়েছিলেন। ‘ব্যাংকে টাকা না থাকলে প্রয়োজনে তিনি স্থানীয় বাজারের একটি ভিট বিক্রি করে হলেও সেই টাকা দিবেন।’

তার বাড়ি থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অন্য উপজেলায় গিয়ে ১০ লাখ টাকার চেক প্রদানের বিষয়টি দলের অনেকেই ভালভাবে দেখেননি। পরদিন রোববার (২৬ অক্টোবর) জানা যায়, নূর কাশেমের ব্যাংক হিসেবে (কৃষি ব্যাংক, তাহিরপুর উপজেলা শাখা) মাত্র ৩ হাজার ৮৩৪ টাকা আছে। যদিও ওইদিন বিকেলেই একটি সভায় নূর কাশেমকে চেকটি ফেরত দেন কামরুজ্জামান কামরুল। 

এদিকে সোমবার (২৭ অক্টোবর) বিকেলে ১০ লাখ টাকার চেক প্রদানকারী নূর কাশেমকে নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে মন্দিয়াতা গ্রামের কাছের হাটখোলা বাজার এলাকায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাড. রনজিত চন্দ্র সরকারের মিছিলে অন্যদের সঙ্গে নূর কাশেমের নৌকার শ্লোগান দেওয়ার দৃশ্য। সমাবেশে বিএনপি নেতাকে ১০ লাখ টাকার চেক প্রদানকারীর মুখে নৌকা ও আওয়ামী লীগের শ্লোগান দেওয়ার ভিডিও প্রকাশ পাওয়ায় চলছে সমালোচনার ঝড়। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাহিরপুর উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা। 

স্থানীয় একজন শিক্ষক জানিয়েছেন, নূর কাশেম এখন বিএনপির কর্মী দাবি করলেও তিনি ইতোপূর্বে জাতীয় সংসদ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও নৌকা পক্ষের মিছিলে গলা ফাটিয়েছেন। 

এই বিষয়ে জানতে চাইলে নূর কাশেম প্রথমে বলেন, ‘আমি কোনো দল করি না, আওয়ামী লীগ-বিএনপির কোনো পদ নাই আমার। আমি আবেগে কামরুল সাবরে ১০ লাখ টাকার চেক দিয়েছিলাম। তিনি চেকটি ফেরত দিয়েছেন।’

এরপর তিনি বলেন, ‘আমার বাবা বিএনপি করতেন। আমি ২০১৪ সালে নৌকায় করে মিছিল দিয়ে সিলেটের বিএনপির প্রোগ্রামে গিয়েছি।’

পরে অভিযোগ করে নূর কাশেম বলেন, ‘কয়েক বছর আগে হাটখোলা বাজারে রনজিত সরকারের মিছিলে গিয়েছিলাম সঠিক, সেদিন আমাকে জোর করে নেওয়া হয়েছিল।’ তবে কারা জোর করে মিছিলে নিয়েছিল তা জানাতে পারেননি তিনি। চেক দিয়ে সুবিধা আদায়ের অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেন। 

তাহিরপুর উপজেলা শ্রমিক দলের সভাপতি ফেরদৌস আলম বলেন, ‘১০ লাখ টাকার চেক প্রদানকারী ব্যক্তি আওয়ামী লীগের লোক। তার বাড়ি বিশেষ একটি অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়। যে এলাকা দিয়ে চুনাপাথর ও কয়লা পরিবহন করা হয়। সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য এসব প্রচেষ্টা মাত্র। আমাদের ধারণা চেক কাণ্ডের বিষয়টি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।’

তাহিরপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে বিএনপির ভোটের অভাব নেই। এমন অপকৌশল করে ভোট বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। দলীয় সমাবেশে ১০ লাখ টাকার চেক প্রদান ও গ্রহণ করা সস্তা রাজনীতির অংশ। বিভক্তির রাজনীতির কারণে এসব কাজ হচ্ছে। এতে দলের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে, দল বিতর্কিত হচ্ছে। আমরা চাই ঐক্যবদ্ধ রাজনীতি। দলের কর্মী হিসেবে আমরা এসব বিষয়ে বিব্রতবোধ করছি। কারণ সোমবার দেখলাম চেক প্রদানকারী আওয়ামী লীগের মিছিলে নৌকার শ্লোগান দিচ্ছেন।’

এ বিষয়ে কথা বলতে কামরুজ্জামান কামরুলকে একাধিক বার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি তিনি। তার ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত তাহিরপুর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জুনাব আলী বলেন, ‘কামরুল একজন জনপ্রিয় নেতা। কৌশল করে তার ভোট বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। নূর কাশেম ভালবেসেই তাকে চেক দিয়েছিলেন। এখানে অন্য কোনো কিছু নেই।’

প্রসঙ্গত, গত শনিবার বিকেলে বিএনপির ৩১ দফার প্রচার ও ধানের শীষের পক্ষে জামালগঞ্জের সাচনাবাজারে একটি সমাবেশ হয়। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী কামরুজ্জামান কামরুল। একপর্যায়ে কর্মীরা তাকে ফুল ও টাকার মালা গলায় দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। তখন নুর কাশেম মঞ্চে উঠে কামরুজ্জামানের হাতে ১০ লাখ টাকার চেকটি তুলে দেন। 

আমাদের সময়/আরডি