জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথনকশা চূড়ান্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক
২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩৮
শেয়ার :
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথনকশা চূড়ান্ত

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতির সুপারিশ প্রায় চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। চলছে শেষ মুহূর্তের ভুলক্রটি সংশোধনের কাজ। এ জন্য আজ সোমবার ফের বৈঠকে বসছে কমিশন। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে আজ বিকালে কিংবা আগামীকাল মঙ্গলবার সরকারের কাছে জমা দিতে চায় কমিশন।

ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ চূড়ান্ত করার জন্য আমরা সোমবার আবারও বসব। আশা করছি, এই বৈঠকের পরই আমরা সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ চূড়ান্ত করতে পারব। 

জানা গেছে, শেষ মুহূর্তের বৈঠকে সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট, সেই ভোটের আহ্বানে আদেশ নাকি অধ্যাদেশ জারি করা হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। বিশেষ করে গত কয়েকদিনের বৈঠকে সংবিধান সংস্কারের জন্য গণভোটের মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদকে সাংবিধানিক পরিষদের যে ক্ষমতা দেওয়া হবে, তার কার্যকাল কতদিন থাকবে, সেটা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে সংস্কারের জন্য নয় মাস সময় নির্ধারণ করা হলেও সেটা পরামর্শ আকারে দেওয়া হবে নাকি নির্দেশ আকারে থাকবে তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। গতকাল বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও সবকিছুই আজ সোমবারের বৈঠকে চূড়ান্ত করা হবে।

কমিশন সূত্র জানিয়েছে, অধ্যাদেশ নয়, গণভোটের জন্য দুটি আদেশ জারি করতে হবে। একটি হবে গণভোটের জন্য। অপরটি গণভোট কীভাবে আয়োজন করা হবে, কারা ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা থাকবেন- সার্বিক প্রক্রিয়া নিয়ে। এক্ষেত্রে সংসদ নির্বাচনের দিন কিংবা তার আগে যে কোনো সময় গণভোট করা যায় বলে পরামর্শ দিয়েছেন আইনজ্ঞরা। এ ছাড়া সংসদের প্রথম ৯ মাস নির্বাচিত সংসদ স্বাভাবিক কার্যক্রমের পাশাপাশি সাংবিধানিক পরিষদ হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। এই বিষয়টিও আদেশে উল্লেখ থাকবে।

কমিশন সূত্রে আরও জানা গেছে, কমিশন সরকারের কাছে যে সুপারিশ করতে যাচ্ছে তাতে এখন পর্যন্ত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশের নাম হবে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ-২০২৫’। তবে গণভোটের সময় নিয়ে মতপার্থক্য থাকায় এটা কমিশন সরকারের ওপর ছেড়ে দিতে পারে। এক্ষেত্রে কমিশন বিএনপির দাবি সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট আয়োজনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিক নিয়েই আলোচনা করে। তেমনই জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ অন্য দলগুলো যে আগে গণভোট চাচ্ছে, তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক নিয়েও আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে। একইভাবে গণভোটের সিদ্ধান্ত আদেশ নাকি জুলাই সনদের ওপর হবে তা নিয়েও একাধিক মতামত এসেছে। 

তবে কমিশনের কেউ কেউ মনে করছেন- যেহেতু আদেশ জুলাই সনদেরই অংশ এবং সনদও আদেশের অংশ; তাই একটা আরেকটার পরিপূরক। এ জন্য গণভোট আদেশের ওপর হলেও তাতে মূল উদ্দেশ্য একই থাকবে। এক্ষেত্রে নোট অব ডিসেন্টের বিষয়টি নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে, সেটাও এড়ানো সম্ভব হবে।

জানা গেছে, রাজনৈতিক দল ও আইন বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মাধ্যমে যে পর্যন্ত উপনীত হওয়া গেছে তাতে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে জনগণের মতামত পাওয়ার পর পরবর্তী সংসদ একই সঙ্গে সংসদ ও সংবিধান সংস্কার পরিষদের দ্বৈত ভূমিকায় থাকবে। পরবর্তী সরকার গঠন হওয়ার পর এই সংসদ পরবর্তী ৯ মাসের মধ্যে সংবিধান সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্তন করে জুলাই সনদে উল্লিখিত সংস্কারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। এখন পর্যন্ত এভাবেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করার চিন্তা করা হচ্ছে। 

কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য এখন পর্যন্ত দুটি বিষয় সবাই একমত। একটি হচ্ছে গণভোট, আরেকটি হচ্ছে সাংবিধানিক পরিষদ। তবে গণভোটের সময় নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য যেমন রয়েছে, তেমন আদেশ নাকি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এটা আহ্বান করা হবে সেটা নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে। আমরা দলগুলোর পরামর্শ ও যুক্তিগুলোর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিকই বিশ্লেষণ করছি। আশা করছি সোমবারের বৈঠকে এটা চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।

এদিকে কমিশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, কমিশনের সদস্যরা সকালে বৈঠকের পর আজ বিকালে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কিত সুপারিশ জমা দেবেন।

এদিকে গতকাল বিকালে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কিত সুপারিশ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সভা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমএ মতিন, সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূইয়া, 

ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন। অন্যদিকে আলোচনায় কমিশনের পক্ষে অংশ নেন সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। এ ছাড়া জাতীয় ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও সভায় উপস্থিত ছিলেন।

আইনি ভিত্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি শহীদ পরিবারের : এদকে গতকাল সকালে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছে জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্যরা। এ সময় তারা বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের একটি আইনি ভিত্তি থাকা প্রয়োজন, একই সঙ্গে তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টিও জরুরি। এ বিষয়ে উপস্থিত সকল শহীদ পরিবারের সদস্যরা একমত পোষণ করেন। জাতীয় সংসদের এলডি হলে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্যরা কমিশনকে অবহিত করেন যে, যেসব আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তাদের সন্তানরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তা আজও পূরণ হয়নি। বরং বিভিন্ন দপ্তরে তারা নানাভাবে লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। তারা জানান, নানা সময়ে নিজেদের সমস্যাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করলেও অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।

কমিশনের পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়, তারা অবগত যে জুলাই ফাউন্ডেশন এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তবে শহীদ পরিবারবর্গ যে প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না এবং বঞ্চনার শিকার হচ্ছেনÑ তা তাদের জানা ছিল না। কমিশন আশ্বস্ত করে যে, উত্থাপিত সব বিষয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট পৌঁছে দেওয়া হবে। এ ছাড়া শহীদ পরিবারবর্গ যখন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা প্রকাশ করবে, কমিশন এ ব্যাপারে তাদের সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করে।

বৈঠকে জুলাই শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের হয়ে উপস্থিত ছিলেনÑ আলহাজ শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া (শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা), মীর মোস্তাফিজুর রহমান (শহীদ মুগ্ধর বাবা), মো. মহিউদ্দীন (শহীদ ইয়ামিনের বাবা), কবির হোসেন (শহীদ জাবির ইব্রাহিমের বাবা), মোহাম্মদ আবদুল মতিন (শহীদ শাহরিয়ারের বাবা), মো. গোলাম রাজ্জাক (শহীদ রিয়ানের বাবা), মো. গাউছ উল্লাহ (শহীদ আব্দুল্লাহের ভাই), সাইফ আহমেদ খান (শহীদ আব্দুল হান্নানের ছেলে), মো. ওবায়দুল হক ও সৈয়দ গাজীউর রহমান (শহীদ মোন্তাসিরের বাবা)।