শিল্পকর্ম ও রত্ন চুরির যত ঘটনা
জাদুঘরগুলো মানবসভ্যতার ইতিহাস, শিল্প এবং সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ রক্ষা করে। এই সংগ্রহশালাগুলো শুধু শিল্পকর্ম বা ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ করে না, বরং সেগুলোর মাধ্যমে আমাদের অতীতের গল্প বলে। কিন্তু এই অমূল্য সম্পদগুলো প্রায়শই চোর-ডাকাতদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। ইতিহাসে এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যেখানে বিশ্বের বিখ্যাত জাদুঘরগুলো থেকে শিল্পকর্ম, রত্ন বা ভাস্কর্য চুরি গেছে। এই ঘটনাগুলো শুধু অপরাধের গল্প নয়, বরং নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতা, মানুষের লোভ এবং শিল্পের প্রতি আকর্ষণের প্রতিফলন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন শামস বিশ্বাস
ল্যুভর জাদুঘরে মোনালিসা (১৯১১)
১৯১১ সালে ফ্রান্সের প্যারিসের ল্যুভর জাদুঘর থেকে চুরি হয় বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসা। ইতালীয় শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির এই মাস্টারপিস চুরি করেন ইতালীয় নাগরিক ভিনসেনসো পেরুজ্জা। তিনি জাদুঘরের কর্মীদের মতো সাদা পোশাক পরে ২১ আগস্ট সকাল ৭টায় প্রবেশ করেন। জাদুঘর তখন প্রায় ফাঁকা ছিল। পেরুজ্জা মোনালিসা কোটের নিচে লুকিয়ে বেরিয়ে যান। তিনি দাবি করেন, ইতালির এই শিল্পকর্মটি ইতালিতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি এই কাজ করেছেন। দুই বছর পর, ১৯১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর, ফ্লোরেন্সে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং চিত্রকর্মটি উদ্ধার হয়। এই ঘটনা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত শিল্প চুরি হিসেবে বিবেচিত হয়। ল্যুভরের নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে রত্ন (১৯৬৪)
১৯৬৪ সালে নিউইয়র্কের আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে চুরি হয় মূল্যবান রত্ন। জ্যাক মার্ফ, যিনি ‘মার্ফ দ্য সার্ফ’ নামে পরিচিত হন, জাদুঘরের প্রাচীর বেয়ে পঞ্চম তলার জানালা দিয়ে প্রবেশ করেন। তিনি স্টার অব ইন্ডিয়া নি (৫৬৩ ক্যারেট নীলকান্তমণি) ডি লং স্টার রুবি এবং ইগল ডায়মন্ড চুরি করে পালিয়ে যান। এই ঘটনা তৎকালীন সময়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। জ্যাক পরে ধরা পড়েন এবং ৩ বছরের কারাদণ্ড পান। এই চুরি প্রমাণ করে যে, শারীরিক নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতা কীভাবে চোরদের সুযোগ করে দেয়। জাদুঘরটি পরবর্তীতে তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নত করে। রত্নগুলো উদ্ধার হয়, কিন্তু স্টার অব ইন্ডিয়ার একটি কোণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই চুরি হলিউডের টোপকাপি (১৯৬৪) চলচ্চিত্রের অনুপ্রেরণা হয়।
ইজাবেলা স্টুয়ার্ট গার্ডনার
মিউজিয়ামে চিত্রকর্ম (১৯৯০)
১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ইজাবেলা স্টুয়ার্ট গার্ডনার মিউজিয়ামে ঘটে এক অভূতপূর্ব চুরির ঘটনা। রাত ১টা ২৪ মিনিটে দুই ব্যক্তি বোস্টন পুলিশের পোশাক পরে জাদুঘরে প্রবেশ করে। তারা নিরাপত্তারক্ষীদের হাতকড়া পরিয়ে ৮১ মিনিটে ১৩টি শিল্পকর্ম চুরি করে পালিয়ে যায়। এর মধ্যে ছিল রেমব্রান্ডের তিনটি এবং ইয়োহানেস ভার্মিয়েরের দ্য কনসার্ট চিত্রকর্ম। চুরি যাওয়া শিল্পকর্মের মূল্য ছিল ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এই ঘটনার পর জাদুঘরে খালি ফ্রেম ঝুলিয়ে রাখা হয়, যা চুরির একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এফবিআইয়ের তদন্তে জানা যায়, চোররা বোস্টনের আইরিশ মবের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আজও এই শিল্পকর্মগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত শিল্প চুরির ঘটনাগুলোর একটি।
অসলো ন্যাশনাল গ্যালারিতে
দ্য স্ক্রিম (১৯৯৪)
১৯৯৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, নরওয়ের লিলিহ্যামারে শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনের দিন, অসলো ন্যাশনাল গ্যালারি থেকে চুরি হয় এডওয়ার্ড মুংকের দ্য স্ক্রিম। দুই চোর জাদুঘরের জানালা ভেঙে ৫০ সেকেন্ডে দ্য স্ক্রিম চুরি করে। তারা একটি নোট রেখে যায় : ‘দুর্বল নিরাপত্তার জন্য ধন্যবাদ।’ চোররা ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মুক্তিপণ দাবি করে, কিন্তু গ্যালারি তা প্রত্যাখ্যান করে। নরওয়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৭ মে চিত্রকর্মটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে। চারজনকে ৪-৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যার মধ্যে পাল এঙ্গারও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যিনি ১৯৮৮ সালে মুঞ্চের লাভ অ্যান্ড পেইন চুরির জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। আইনি কারণে তাদের আপিলের মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল; তারা মিথ্যা পরিচয়ে নরওয়েতে প্রবেশ করেছিলেন।
ড্রেনথে মিউজিয়ামে শিল্পকর্ম (২০১২)
২০১২ সালের ১৬ অক্টোবর রাতে, নেদারল্যান্ডসের রটারডামের কুনৎসহাল গ্যালারিতে একটি লোমহর্স ও দ্রুততম শিল্প চুরির ঘটনা ঘটে, যা শিল্পজগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। মাত্র তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যে চোররা সাতটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম চুরি করে পালিয়ে যায়। এই চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে ছিল পাবলো পিকাসোর হারলেকুইনস হেড (১৯৭১), ক্লদ মোনের ওয়াটারলিলিজ (১৮৯৮) ও চ্যারিং ক্রস ব্রিজ (১৯০১), অঁরি মাতিসের রিডিং গার্ল ইন হোয়াইট অ্যান্ড ইয়েলো (১৯১৯), পল গগাঁর গার্ল ইন ফ্রন্ট অব অ্যান ওপেন উইন্ডো (১৮৯৮), মায়ার মেয়োলের জিন হেকটার (১৯৪৩), এবং লুসিয়ান ফ্রয়েডের উইম্যান উইথ আইজ ক্লোজড (২০০২)। এই চিত্রকর্মগুলোর মোট মূল্য ছিল প্রায় ২০ মিলিয়ন ইউরো, যা এটিকে ইউরোপের ইতিহাসে অন্যতম বড় শিল্প চুরির ঘটনা।
আরও পড়ুন:
রোগীর পেটে জীবন্ত মাছি!
চোররা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজটি সম্পন্ন করে। তারা জাদুঘরের পেছনের প্রবেশদ্বার ভেঙে প্রবেশ করে এবং নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ফাঁকি দেয়। তৎকালীন সময়ে কুনৎসহাল গ্যালারির নিরাপত্তাব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে দুর্বল ছিল এবং অ্যালার্ম সিস্টেম দ্রুত নিষ্ক্রিয় করা হয়। চোররা চিত্রকর্মগুলো দেয়াল থেকে খুলে নিয়ে একটি গাড়িতে করে দ্রুত পালিয়ে যায়। তদন্তে জানা যায়, এই চুরি একটি রোমানিয়ান অপরাধী সিন্ডিকেটের কাজ ছিল, যারা আন্তর্জাতিক কালোবাজারে শিল্পকর্ম বিক্রির জন্য পরিচিত।
২০১৩ সালে তদন্তকারীরা রোমানিয়ায় একাধিক সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করে, যার মধ্যে মূল অভিযুক্ত ওলগা ডোগারু ছিলেন। তবে তদন্ত একটি মর্মান্তিক মোড় নেয় যখন ওলগার মা, মিসেস ডোগারু, দাবি করেন যে তিনি পুলিশের হাত থেকে প্রমাণ লুকাতে চিত্রকর্মগুলো তার গ্রামের বাড়ির চুলায় পুড়িয়ে ফেলেছেন। তিনি বলেন, ছবিগুলো আবর্জনার সঙ্গে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং চুলার ছাইয়ে পিকাসো ও মোনের কাজের রঙ্গক পাওয়া যায়। এই দাবি শিল্পজগতে একটি অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ এই মাস্টারপিসগুলোর ধ্বংস হওয়া শিল্প ইতিহাসের জন্য একটি বড় ক্ষতি।
কুনৎসহিস্টোরিশেস মিউজিয়ামে
সেলিনি সল্ট সেলার (২০০৩)
২০০৩ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার কুনৎসহিস্টোরিশেস মিউজিয়াম থেকে চুরি হয় বেনভেনুতো সেলিনির সোনার তৈরি সেলিনি সল্ট সেলার। এই ভাস্কর্যটি ১৫৪৩ সালে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। চুরির সময় জাদুঘরে সংস্কারকাজ চলছিল এবং স্ক্যাফোল্ডিংয়ের সুযোগ নিয়ে চোর রবার্ট মাঙ্গ প্রবেশ করে। অ্যালার্ম সিস্টেম উপেক্ষিত হয়। ২০০৬ সালে ভিয়েনার কাছে একটি বনে সিসার বাক্সে পুঁতে রাখা অবস্থায় এটি উদ্ধার হয়। মাঙ্গকে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সাও পাওলো মিউজিয়াম অব
আর্টে চিত্রকর্ম (২০০৭)
২০০৭ সালের ২০ ডিসেম্বর রাতে ব্রাজিলের সাও পাওলো মিউজিয়াম অব আর্টে একটি অত্যন্ত দ্রুত এবং পরিকল্পিত চুরির ঘটনা ঘটে। তিনজন সশস্ত্র ডাকাত মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে দুটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম চুরি করে পালিয়ে যায়। এগুলো ছিল পাবলো পিকাসোর পোর্ট্রেট অব সুজান ব্লখ এবং ব্রাজিলীয় শিল্পী ক্যান্ডিডো পোর্টিনারির দ্য কফি ওয়ার্কার। এই চিত্রকর্ম দুটির মূল্য তখনকার হিসাবে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ব্রাজিলীয় রিয়েল (প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ছিল।
চোররা জাদুঘরের নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিল। তারা প্রথমে একটি হাইড্রোলিক জ্যাক ব্যবহার করে জাদুঘরের প্রধান প্রবেশদ্বার ভেঙে ঢোকে এবং নিরাপত্তা প্রহরীদের হুমকি দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে। অ্যালার্ম সিস্টেমটি অকার্যকর ছিল এবং সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো সঠিকভাবে মনিটর করা হয়নি। চোররা দ্রুত চিত্রকর্ম দুটি খুলে নিয়ে একটি গাড়িতে করে পালিয়ে যায়। এই ঘটনা ব্রাজিলের শিল্পজগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে, কারণ দ্য কফি ওয়ার্কার ব্রাজিলের শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের একটি প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
তদন্তে পুলিশ তিন সপ্তাহের মধ্যে সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করে। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে সাও পাওলোর একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে চিত্রকর্ম দুটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তদন্তে জানা যায়, চোররা চিত্রকর্মগুলো কালোবাজারে বিক্রির পরিকল্পনা করেছিল।
মন্ট্রিল মিউজিয়াম অব ফাইন
আর্টসে চিত্রকর্ম (১৯৭২)
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
১৯৭২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, কানাডার মন্ট্রিল মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টসে একটি লোমহর্ষ এবং পরিকল্পিত চুরির ঘটনা ঘটে, যা কানাডার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শিল্প চুরি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তিনজন সশস্ত্র চোর জাদুঘরের ছাদের স্কাইলাইট দিয়ে প্রবেশ করে এবং নিরাপত্তা প্রহরীদের বন্দুকের মুখে জিম্মি করে বেঁধে ফেলে। তারা মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে ১৮টি মূল্যবান চিত্রকর্ম চুরি করে পালিয়ে যায়। এই চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে ছিল ডাচ মাস্টার রেমব্রান্ডের ল্যান্ডস্কেপ উইথ কটেজ, ফ্লেমিশ শিল্পী পিটার পল রুবেন্সের কাজ এবং জান ব্রুগেল দ্য এল্ডারের একটি ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিং। এ ছাড়াও অন্যান্য ইউরোপীয় শিল্পীদের কাজ ছিল, যার মোট মূল্য তৎকালীন সময়ে প্রায় ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল (বর্তমান মূল্যে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি)। চোররা দড়ি এবং অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করে ছাদের স্কাইলাইট ভেঙে প্রবেশ করে এবং জাদুঘরের দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থার সুযোগ নেয়। তৎকালীন সময়ে জাদুঘরে উন্নত সিসিটিভি বা মোশন সেন্সরের মতো প্রযুক্তি ছিল না এবং প্রহরীর সংখ্যাও অপর্যাপ্ত ছিল। চুরির পর পুলিশ তদন্ত শুরু করে এবং কিছু সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, কিন্তু কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসেনি। দুর্ভাগ্যবশত, চুরি যাওয়া চিত্রকর্মগুলোর বেশিরভাগই আজ পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি এবং ধারণা করা হয় এগুলো কালোবাজারে বিক্রি হয়ে গেছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ঘটনা কানাডার শিল্পজগতে একটি অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
ভ্যান গগ মিউজিয়ামে চিত্রকর্ম (২০০২)
২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর আমস্টারডামের ভ্যান গগ মিউজিয়াম থেকে ভিনসেন্ট ভ্যান গগের দুটি চিত্রকর্ম ভিউ অব দ্য সি অ্যাট শেভেনিঙেন এবং কংগ্রিগেশন লিভিং দ্য রিফর্মড চার্চ ইন নুয়েনেন চুরি হয়। চোররা ছাদ ভেঙে প্রবেশ করে এবং মাত্র কয়েক মিনিটে চিত্রকর্মগুলো নিয়ে পালিয়ে যায়। এই চিত্রকর্মগুলোর মূল্য ছিল প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার। ২০১৬ সালে ইতালির নেপলসে একটি মাফিয়া গ্রুপের কাছ থেকে এগুলো উদ্ধার করা হয়, যা শিল্প চুরির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার একটি সফল উদাহরণ।
সুইডিশ মিউজিয়ামে পোর্ট্রেট (২০০০)
২০০০ সালের ২২ ডিসেম্বর সুইডেনের স্টকহোমের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে তিনজন সশস্ত্র ও মুখোশধারী চোর প্রবেশ করে তিনটি মূল্যবান চিত্রকর্ম চুরি করে। এগুলো ছিল রেমব্রান্ডের সেলফ-পোর্ট্রেট (১৬৩০) এবং পিয়ের-অগাস্ট রেনোয়ারের ইয়ং প্যারিসিয়ান (১৮৭৪) ও কনভারসেশন উইথ দ্য গার্ডনার। চিত্রকর্মগুলোর মূল্য ছিল প্রায় ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চোররা জাদুঘরের বাইরে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজটি সম্পন্ন করে। তারা প্রথমে জাদুঘরের বাইরে একটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিরাপত্তা প্রহরীদের বিভ্রান্ত করে। এরপর তারা মুখোশ পরে জাদুঘরে প্রবেশ করে, প্রহরীদের বন্দুকের মুখে জিম্মি করে এবং চিত্রকর্মগুলো খুলে নিয়ে স্পিডবোটে করে স্টকহোমের জলপথ দিয়ে পালিয়ে যায়, যা এই ঘটনাকে আরও নাটকীয় করে তোলে। সুইডিশ পুলিশ এবং এফবিআইয়ের সমন্বিত তদন্তে ২০০১ সালে ইয়ং প্যারিসিয়ান স্টকহোমে এবং ২০০৫ সালে বাকি দুটি চিত্রকর্ম ডেনমার্ক ও লস অ্যাঞ্জেলেসে উদ্ধার হয়। তদন্তে জানা যায়, চোররা একটি আন্তর্জাতিক অপরাধীচক্রের সদস্য ছিল এবং তারা চিত্রকর্মগুলো কালোবাজারে বিক্রির চেষ্টা করছিল।
মুংক মিউজিয়ামে দ্য স্ক্রিম
ও ম্যাডোনা (২০০৪)
২০০৪ সালের ২২ আগস্ট, দিনের আলোয় অসলোর মুংক মিউজিয়ামে মুখোশধারী দুই সশস্ত্র ডাকাত দিবালোকে প্রবেশ করে এডওয়ার্ড মুংকের দ্য স্ক্রিম (১৯১০ সংস্করণ) এবং ম্যাডোনা চিত্রকর্ম চুরি করে। এক পথচারী ডাকাতদের গাড়িতে পালানোর সময় ছবি তুলে ফেলেন, যা তদন্তে সহায়ক হয়। ২০০৫ সালের এপ্রিলে একজন সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার হলেও চিত্রকর্মগুলো তখনও নিখোঁজ ছিল। গুজব ছড়ায় যে, চোররা প্রমাণ নষ্ট করতে ছবিগুলো পুড়িয়ে ফেলেছে। ২০০৫ সালের জুনে অসলো সিটি সরকার চিত্রকর্ম উদ্ধারের তথ্যের জন্য ২০ লাখ নরওয়েজিয়ান ক্রোন (প্রায় ৩,১৩,৫০০ মার্কিন ডলার) পুরস্কার ঘোষণা করে। ২০০৬ সালের ৩১ আগস্ট পুলিশ দ্য স্ক্রিম ও ম্যাডোনা উদ্ধার করে, যা প্রত্যাশার চেয়ে ভালো অবস্থায় ছিল। দ্য স্ক্রিম-এর নিচের বাম কোণে আর্দ্রতার ক্ষতি এবং ম্যাডোনায় কয়েকটি ছিঁড়ে যাওয়া ও দুটি গর্ত ছিল। তিনজনকে ৪-৮ বছরের কারাদণ্ড এবং ৭৫০ মিলিয়ন ক্রোন ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এই ঘটনার পর মিউজিয়ামটি প্রায় ১০ মাস বন্ধ রেখে নিরাপত্তাব্যবস্থা সংস্কার করে।
প্যারিস মিউজিয়াম অব মডার্ন
আর্টে চিত্রকর্ম (২০১০)
২০১০ সালে ভেরান তোমিক, ‘স্পাইডার-ম্যান অব প্যারিস’ নামে পরিচিত, প্যারিস মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে জানালা দিয়ে প্রবেশ করে পাঁচটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম চুরি করেন। এর মধ্যে ছিল পাবলো পিকাসো, অঁরি মাতিস, আমেদিও মোদিলিয়ানি, জর্জ বাক ও ফেহনো লিজির কাজ। এই চিত্রকর্মগুলোর মূল্য ছিল প্রায় ৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তোমিক দাবি করেন, তিনি শিল্পের প্রতি ভালোবাসা থেকে এগুলো চুরি করেছিলেন। পুলিশ পরে তাকে গ্রেপ্তার করে।
ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
প্রতিকৃতি প্রচেষ্টা (১৯৫৬)
১৯৫৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্টে একটি উল্লেখযোগ্য চুরির চেষ্টা ঘটে। লুইস আর গার্সিয়া নামের এক ব্যক্তি ইতালীয় রেনেসাঁ শিল্পী রাফায়েলের বিখ্যাত চিত্রকর্ম অ্যালবা ম্যাডোনা চুরির চেষ্টা করেন। এই চিত্রকর্মটি ১৬শ শতাব্দীর প্রথম দিকে আঁকা, মেরি এবং শিশু যিশুর একটি আধ্যাত্মিক প্রতিকৃতি হিসেবে বিশ্বব্যাপী শিল্পপ্রেমীদের কাছে প্রিয়। গার্সিয়া জাদুঘরে প্রবেশ করেন এবং চিত্রকর্মটি দেয়াল থেকে খুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি ছবিটি ফ্রেম থেকে কেটে ফেলার জন্য একটি ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করছিলেন, কিন্তু নিরাপত্তা প্রহরীদের দ্রুত হস্তক্ষেপে তিনি ধরা পড়েন। এই ঘটনাটি শিল্প চুরির ইতিহাসে একটি পূর্ণাঙ্গ চুরি হিসেবে সম্পন্ন না হলেও জাদুঘরের নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ করে।
তৎকালীন সময়ে ন্যাশনাল গ্যালারির নিরাপত্তা তুলনামূলকভাবে সাধারণ ছিল এবং এই ঘটনা কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করে। ঘটনার পর জাদুঘরে বুলেটপ্রুফ গ্লাস দিয়ে শিল্পকর্ম রক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে অন্যান্য জাদুঘরের জন্যও একটি মানদণ্ড হয়ে ওঠে।
ই জি বুহরল মিউজিয়ামে চিত্রকর্ম (২০০৮)
এটি ইউরোপের শিল্পজগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনজন মুখোশধারী চোর দিনের আলোয় জাদুঘরে প্রবেশ করে এবং মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে চারটি মূল্যবান চিত্রকর্ম চুরি করে পালিয়ে যায়। চুরি হওয়া চিত্রকর্মগুলো ছিল : ক্লদ মোনের পপলার্স (১৮৯১), ভিনসেন্ট ভ্যান গগের ব্লসমিং চেস্টনাট ব্রাঞ্চেস (১৮৯০), এডগার দেগার কাউন্ট লেপিক অ্যান্ড হিজ ডটার্স (১৮৭০) এবং পল সেজ্যানের বয় ইন দ্য রেড ভেস্ট (১৮৮৮-৯০)। এই চিত্রকর্মগুলোর মোট মূল্য ছিল প্রায় ১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা এই ঘটনাকে বিশ্বের বৃহত্তম শিল্প চুরিগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত করে। চোররা জাদুঘরের নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করে। তারা প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে প্রবেশ করে, নিরাপত্তা প্রহরীদের হুমকি দেয় এবং চিত্রকর্মগুলো দেয়াল থেকে খুলে নিয়ে একটি অপেক্ষমাণ গাড়িতে পালিয়ে যায়। তৎকালীন সময়ে জাদুঘরে সিসিটিভি ক্যামেরা এবং অ্যালার্ম সিস্টেম থাকলেও চোররা এগুলো ফাঁকি দেওয়ার জন্য উন্নত কৌশল ব্যবহার করে। তদন্তে জানা যায়, এই চুরি একটি আন্তর্জাতিক অপরাধীচক্রের সঙ্গে জড়িত ছিল, যারা কালোবাজারে শিল্পকর্ম বিক্রির পরিকল্পনা করেছিল। ২০১২ সালে সার্বিয়ায় একটি তদন্তের সময় পুলিশ এবং ইন্টারপোলের সমন্বিত অভিযানে সেজ্যানের বয় ইন দ্য রেড ভেস্ট উদ্ধার করা হয়। এই চিত্রকর্মটি অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং এটি শিল্পজগতের জন্য একটি বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে দুর্ভাগ্যবশত, মোনে, ভ্যান গগ এবং দেগার চিত্রকর্ম তিনটি এখনও নিখোঁজ রয়েছে। ধারণা করা হয়, এগুলো হয় কালোবাজারে বিক্রি হয়ে গেছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে।
ল্যুভর জাদুঘরে নেপোলিয়ন
যুগের রত্ন (২০২৫)
২০২৫ সালের ১৯ অক্টোবর স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ৪ মিনিটে ল্যুভরের অ্যাপোলো গ্যালারিতে চার মিনিটের অভিযানে চুরি হয়ে যায় নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত সংগ্রহের ৭টি রত্ন। এর মধ্যে ছিল ১৮০৪ সালের সম্রাজ্য ঘোষণার সময় পরা একটি রুবি ব্রোচ এবং একটি নীলকান্তমণি পেন্ডেন্ট। চোররা সিসিটিভি ক্যামেরার ব্লাইন্ড স্পট ব্যবহার করে, ধোঁয়া বোমা ফাটিয়ে এবং জরুরি দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। এই ঘটনা ল্যুভরের ইতিহাসে প্রথম দিনের আলোয় এত দ্রুত চুরির রেকর্ড। তদন্তে জানা যায়, চোররা ৬ মাস ধরে জাদুঘরের কর্মী সেজে পরিকল্পনা করছিল। রত্নগুলোর বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ১২০ মিলিয়ন ইউরো। এই ঘটনা জাদুঘরের নিরাপত্তাব্যবস্থার ত্রুটি প্রকাশ করেছে। চোররা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজটি সম্পন্ন করে এবং দ্রুত পালিয়ে যায়। এই রত্নগুলো ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অমূল্য ছিল। তদন্তে দেখা গেছে, চোররা সম্ভবত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিল এবং জাদুঘরের নিরাপত্তা ক্যামেরা ও অ্যালার্ম সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়েছিল। এই ঘটনা ল্যুভরের ইতিহাসে আরেকটি কালো অধ্যায় যোগ করেছে এবং বিশ্বব্যাপী জাদুঘর নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।