হারিয়ে যাওয়া পরিবার ফিরছে নাটকে

ফয়সাল আহমেদ
২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০১
শেয়ার :
হারিয়ে যাওয়া পরিবার ফিরছে নাটকে

একটা সময় নাটকের ক্ষেত্রে পারিবারিক গল্পই গুরুত্ব পেয়েছে। পারিবারিক বন্ধনের কথা নাটকে জোর দিয়ে বলা হতো। নায়ক-নায়িকাই গল্পের প্রধান বিবেচ্য নয়। তাদের বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-চাচি, খালা-খালু, ফুফা-ফুফু, দাদা-দাদি, নানা-নানি, নায়ক-নায়িকার বন্ধুবান্ধব, স্কুল-কলেজের প্রিয় শিক্ষক- এ ধরনের চরিত্রগুলো নাটকে বেশ গুরুত্ব পেত। এখন টিভি নাটকে নায়ক-নায়িকার বাইরে সেই অর্থে আর কোনো চরিত্রকে তেমন একটা দেখা যায় না। বেশ অনেক বছর যাবৎই নাটক নিয়ে এমন অভিযোগ সাধারণ দর্শকের। সোনালি যুগে পারিবারিক গল্পের নাটক প্রচার হতো বেশি। টিভি পর্দায় সেসব ধারাবাহিক নাটক দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ত দর্শক। ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘সংশপ্তক’, ‘আজ রবিবার’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘সকাল-সন্ধ্যা’, ‘বন্ধন’, ‘রূপনগর’-এর মতো অসাধারণ কিছু ধারাবাহিকের কথা দর্শক আজও মনে রেখেছে। নাট্যজন আতাউর রহমান বলেছিলেন, ‘পরিবার, সমাজ নিয়েই তো মানুষের জীবন। এ জন্য দর্শক বরাবরই পারিবারিক ও সামাজিক গল্পের নাটক দেখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। একটা সময় তাই ছিল। পারিবারিক ও সামাজিক গল্পের চমৎকার নাটক তৈরি হতো। এখন এসব অতীত।’

আফসোস করে এক প্রযোজক বলেন, ‘সাধ আর সাধ্যের মধ্যে কোনো সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যায় না। নাট্যকার লিখলেন কক্সবাজারের দৃশ্য। সমুদ্রসৈকতে হেঁটে যাচ্ছে নায়ক-নায়িকা। কিন্তু তাদেরকে কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়া এবং ফিরিয়ে আনার কথা ভাবলেই তো বুকে বল পাই না। হয়তো দেখা গেল নাটকে বলা আছে, নায়ক-নায়িকার সঙ্গে বাবা-মা, ভাই-বোনও কক্সবাজারে বেড়াতে যাবে। কিন্তু আমার সাধ্য নেই তো সবাইকে কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়ার। নাটকের বাজেট বাড়বে। কিন্তু নাটক বিক্রি করে তো এত টাকা পাব না। কাজেই বাবা-মায়ের প্রয়োজন নাই। ভাই-বোনের প্রয়োজন নাই। চাচা-চাচি, খালা-খালুর কথা তো ভাবতেই পারি না।’ তার মানে এই নয় যে, পারিবারিক কাহিনির নাটক হচ্ছে না। পারিবারিক গল্পের নাটক হচ্ছে। সেগুলো সাড়াও ফেলছে। গত ঈদুল ফিতরে মুক্তি পেয়েছিল অনেকগুলো নাটক। তার মধ্যে ছিল কয়েকটি পারিবারিক গল্পের নাটক। ‘তোমাদের গল্প’ ও ‘একান্নবর্তী’ নামের নাটক দুটি বেশ দর্শক সমাদৃত হয়েছে। মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত ‘তোমাদের গল্প’ নাটকের গল্পে যৌথ পরিবারের মাঝে বন্ধন অটুট থাকার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে ‘একান্নবর্তী’ নাটকটি পরিচালনা করেছেন মহিন খান। এতেও উঠে এসেছে একান্নবর্তী পরিবারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গল্প। আলোচনার পাশাপাশি নাটকগুলো ছিল ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে।

বর্তমানে টেলিভিশন চ্যানেলের পাশাপাশি বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলেও ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হয়। সেসব নাটকের বেশির ভাগই পরিবারকেন্দ্রিক গল্পের। পারিবারের গল্প নিয়ে বেশি কাজ করছেন নির্মাতা-প্রযোজক মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ। তিনি তার ‘সিনেমাওয়ালা’ চ্যানেল থেকে নিয়মিত নাটক করছেন, সেগুলোর প্রায় সবই পরিবারের গল্প। রাজ বলেন, ‘দর্শক কখনও হারিয়ে যায় না। যারা বলেন দর্শক নেই, ভুল বলেন। দর্শক ঠিকই আছে, কেবল কাজটা দিতে হবে। ব্যবসা করতে গেলে যেমন অনেকে বলে, ব্যবসার অবস্থা ভালো না। অন্যান্য কাজেও এ রকম কথা শুনতে হয়। নাটক-সিনেমা চলে না, দর্শক নেই; এসব শুনতেই শুনতেই এত দিন কাজ করছি।’ এখন তিনি বানাচ্ছেন ‘এটা আমাদেরই গল্প’। এই ধারাবাহিকেরও মূল প্রেক্ষাপট পরিবার। সিনেমাওয়ালার পারিবারিক গল্পের ধারাবাহিক ‘দেনা পাওনা’ পাচ্ছে অসামান্য সাড়া। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে আছেন শহিদুজ্জামান সেলিম, অ্যালেন শুভ্র, মনিরা মিঠু, ডাক্তার এজাজ, শিল্পী সরকার অপু, মুসাফির সৈয়দ বাচ্চু, সুষমা সরকার, এমএনইউ রাজু, এবি রোকন, অনিক প্রমুখ।

নাটকটির পরিচালক কেএম সোহাগ বলেন, ‘পারিবারিক গল্পগুলো দর্শকরা খুব সহজেই কানেক্ট করেছেন। আসলে আমাদের পরিবারের মধ্যে যা কিছু হচ্ছে, সেখান থেকে সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ, ক্রাইসিস সম্পর্ক এগুলো এতে দেখাচ্ছে। অনেক দর্শক নাটকটি দেখে বলছেন, পরিবারের সঙ্গে যে ভুলগুলো করেছে এগুলো করা উচিত হয়নি। এতে করে পারিবারিক সম্পর্ক মজবুত হচ্ছে।’

এনটিভিতে প্রচারিত হচ্ছে গোলাম মুক্তাদিরের ধারাবাহিক নাটক ‘কাজিনস’। তুতো ভাই-বোনদের প্রসঙ্গ ধরে একান্নবর্তী পরিবারের গল্প বলছেন তিনি। মুক্তাদির বলেন, ‘আগে যে একান্নবর্তী পরিবার ছিল, সেই বন্ধনটা ছুটে গেছে। এখন এমন পরিস্থিতিতে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি, পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে, তা-ও জানি না। তাই একটু চেষ্টা করা, পরিবারের সেই বন্ধন ফেরানো যায় কিনা। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই, আমার বাচ্চা যখন স্কুলে যায়, তাকে দেখার কেউ নেই। ওর জন্য আলাদা করে একজন লোক আমার রাখতে হয়। এটা শুধু আমার না, বর্তমানে প্রায় সবার ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা এ রকম। অথচ একান্নবর্তী পরিবার হলে এই সংকট থাকত না। আগে যেমন চাচাতো, খালাতো, মামাতো ভাই-বোনরা একে অন্যের বিভিন্ন সমস্যায় এগিয়ে আসত, এখন তেমন নেই। সেই নস্টালজিয়া ফেরানোর ভাবনা থেকেই নাটকটি বানিয়েছি।’