চোরাচালান ও আসক্তিতে গ্রামেও ভাঙছে বিয়ে

লালমনিরহাটে মাদকের দাপট

নুরুল ফেরদৌস, লালমনিরহাট
২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৫৯
শেয়ার :
চোরাচালান ও আসক্তিতে গ্রামেও ভাঙছে বিয়ে

উত্তরের জেলা লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলাই সীমান্তবর্তী। ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা এসব এলাকায় চোরাচালান ও মাদকের পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব গ্রামে আত্মীয়তা করতেও ভয় পাচ্ছেন মানুষ। গাঁয়ের বদনামে ভেঙে যাচ্ছে বহু ছেলেমেয়ের বিয়ে।

এদিকে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের পরও মাদক ব্যবসায়ীরা রীতিমতো বেপরোয়া। মাত্র দুটি ইউনিয়নেই শতাধিক বড় মাদক ব্যবসায়ী সক্রিয়, যাঁদের মধ্যে অনেক প্রভাবশালী ও জনপ্রতিনিধি আছেন। একেকজনের বিরুদ্ধে ১০ থেকে ১৪টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে। মামলা হচ্ছে একের পর এক, তবুও কমছে না মাদক কারবার। বরং মাদকের সাম্রাজ্য ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটের পরিস্থিতি যেন আরও ভয়াবহ। একজন ইউপি সদস্যের নামেই রয়েছে ১২টি মাদক মামলা। জেলার ছোট দুটি ইউনিয়নেই শতাধিক ‘আলীশান’ বাড়িওয়ালা মাদক ব্যবসায়ী।

জানা গেছে, সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোয় মাদক কারবারিরা এখন শুধু ব্যবসা করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, বরং প্রশাসনের মাদকবিরোধী অভিযান স্তব্ধ করতে শুরু করেছে প্রোপাগাণ্ডা। শতাধিক তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীর দাপটে হিমশিম খাচ্ছে থানা পুলিশ। বড় ডিলারদের নেটওয়ার্ক ভাঙতে গিয়ে উল্টো তাদের আইনি হয়রানির অপচেষ্টার মুখে পড়ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের পরও মাদক পাচার বন্ধ না হওয়ার পেছনে রয়েছে এই শক্তিশালী চক্রের নিত্যনতুন কৌশল।

প্রশাসনের দফায় দফায় অভিযান আর কঠোর অবস্থান নিয়েও লালমনিরহাটের সীমান্ত গ্রামগুলোয় মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ও চন্দ্রপুর ইউনিয়নে মাদকের নেটওয়ার্ক রীতিমতো দুর্ভেদ্য। এটি থানা থেকে দূরে হওয়ায় ২০২১ সালে গোড়লে একটি তদন্ত কেন্দ্র তৈরি করা হলেও শুরুতে আওয়ামী লীগের তদবিরে পুলিশ বিশেষ সফল হতে পারেনি। তবে সম্প্রতি ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর গোড়ল তদন্ত কেন্দ্র কঠোর অবস্থানে যাওয়ায় মাদক ব্যবসায়ীরা কিছুটা চাপে পড়েছে। গত এক বছরে তদন্ত কেন্দ্রটি বিগত দুই বছরের দ্বিগুণেরও বেশি সফলতা পেয়েছে।

২০২২ সালে ‘ইউপি সদস্য বাদশার বাড়িতে ফেনসিডিলের বার’ শিরোনামে ভিডিওসহ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েও জামিনে বেরিয়ে এসেছেন বাদশা। নিজে স্বীকার করেছেন, তিনি একসময় মাদক ব্যবসা করতেন, তবে এখন ছেড়ে দিয়েছেন বলে দাবি করেন।

এ ছাড়া, গোড়ল ইউনিয়নে এক মাদক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অবস্থায় বলেন, অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা বিচারাধীন। আরও অনেকে বড় ডিলার হলেও অনেকের বিরুদ্ধে মামলা নেই। কেবল গোড়ল ইউনিয়নেই এমন শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন।

ভারতীয় মদ, ফেনসিডিল, ট্যাপেন্টা, গাঁজা, ইয়াবা, স্কাপ- সব ধরনের মাদকের নিরাপদ রুট এখন এই এলাকা। মাদক পাচার ও বিক্রি করে রাতারাতি কোটিপতি হয়েছেন অনেক মাদক ডিলার। গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি, কিনেছেন দামি গাড়ি আর জমি।

স্থানীয়রা জানান, হাতের নাগালে মাদক পাওয়ায় নষ্ট হচ্ছে যুবসমাজ থেকে শুরু করে গ্রামের শিক্ষার্থীরা। এই মাদক কারবারিদের কারণে এসব গ্রাম এখন ‘মাদকের গ্রাম’-এ পরিণত হয়েছে। আতঙ্কের এই গ্রামে কেউ আত্মীয়তা করতেও চান না। গ্রামের নামের বদনামে অনেক ছেলেমেয়ের বিয়েও ভেঙে যাচ্ছে।

স্থানীয় অরণ্য স্কুল অ্যান্ড কলেজের নির্বাহী পরিচালক আনজুরুল হক সরকার মিন্টু বলেন, গুটি কয়েক মাদক ব্যবসায়ীর কারণে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। গ্রামগুলোর নামের সঙ্গে মাদকের ট্যাগ পড়ে যাওয়ায় অনেকের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। স্থানীয়রা মাদক নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন।

কৃষক আফাজ উদ্দিনের অভিযোগ, মাদক ব্যবসায়ীরা রাতের আঁধারে চোরাচালানের জন্য জমির ফসল নষ্ট করে। এখন শীতকালে মাদকের সঙ্গে গরুও পাচার করা হয়- এমন তথ্য আছে।

গোড়ল তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ এসআই মোস্তাকিন জানান, যোগদানের এক বছরে তিনি ৭০ জনকে গ্রেপ্তার ও ৬৮টি মামলা করেছেন। মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নানান হুমকি ও হেনস্তার শিকার হলেও তিনি মাদকের সঙ্গে কোনো আপস করবেন না।

কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাকির হোসেন বলেন, সীমান্তের গ্রামে মাদকের ট্যাগ রোধে অভিযান জোরদার করা হচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ীদের কোনো চক্রান্তই সফল হবে না। জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে। তবে আইনের ফাঁক গলে গ্রেপ্তারকৃতরা দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আসায় পাচার দমন করা কঠিন হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।