প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে চাপের মুখে সরকার
দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করার চাপ অব্যাহত রয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে তা আরও বেশি দৃশ্যমান হয়েছে। এ কারণে নিরপেক্ষ কর্মকর্তা ‘খুঁজছে’ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের কাজে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। তদবিরের চাপে জেলা প্রশাসকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন আটকে আছে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিয়ে তদবির। বিভাগীয় কমিশনার নিয়েও আলোচনা সামনে চলে আসছে। নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের পদটি এখনও ফাঁকা। অবস্থার বাস্তবতায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে আপাতত এ দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। ফলে কাজের গতি স্লথ হয়ে গেছে। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয়েছে বিতর্ক এড়াতে বদলি-পদোন্নতির গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পাঠানো হবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে।
জানা গেছে, ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভূমিকায় দেখতে চাইছে রাজনৈতিক দলগুলো। বড় দলগুলো তাদের পছন্দসই নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দেখতে চাইছেন আর ছোট দলগুলো বলছে বড় দলগুলোর মধ্যে ভাগাভাগি চলছে কর্মকর্তাদের পদায়ন নিয়ে।
গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করার দাবি জানায় বিএনপি। সরকারের মধ্যে দলীয় লোক থাকলে তাদের অপসারণের দাবি জানান তারা। গতকাল জামায়াতও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে নিরপেক্ষ প্রশাসন নিয়ে কথা বলেন। বৈঠক শেষে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশসহ বিভিন্ন স্থানে ৮০ শতাংশ লোক একটি দলের। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করতে বলেছি। তারা বলছে, সংখ্যাটি ৮০ না ৬৫ শতাংশ হবে। যদি তা-ও হয়ে থাকে, তা হলে নিরপেক্ষতা রইল কোথায়? নির্বাচনের আগে লটারির মাধ্যমে প্রশাসনে রদবদলের কথা জানানো হয়েছে। আমরা রাজি, তবে সেখানে যেন ভূত না থাকে।
একই দিনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎশেষে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং শুনতে পাচ্ছি যে, প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগবাঁটোয়ারা হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে যারা পরিচয় দেয় তারা প্রশাসন, এসপি, ডিসি ভাগবাঁটোয়ারা করছে। নির্বাচনের জন্য তারা তালিকা করছে এবং সেগুলো সরকারকে দিচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকেও সেই দলগুলোকে সহায়তা করা হচ্ছে। এভাবে চললে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
সংশ্লিষ্টদের মতে, নিরপেক্ষ কর্মকর্তা খুঁজতে গিয়ে বেকায়দায় আছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশাসনকে ‘নিরপেক্ষ’ হতে বলা হচ্ছে। আবার কোন কর্মকর্তা কোথায় দায়িত্ব পালন করলে প্রশাসন ‘দলীয় প্রভাবমুক্ত’ হবেÑ এ রকম নামও প্রস্তাব করা হয়। সচিব থেকে শুরু করে অতিরিক্ত সচিব, জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনারের পদায়নে পরামর্শ আসতে শুরু হয়েছে। আবার কোনো কর্মকর্তাকে নির্দিষ্ট স্থানে বদলির প্রস্তাব করলে আরেক দলের অনুসারীদের পক্ষ থেকে আপত্তি আসে। সরকারের নানা স্তরে এ রকম প্রস্তাব-আপত্তি আসার খবর শোনা যাচ্ছে। নিজের মতাদর্শের ব্যক্তিকে পছন্দের স্থানে বসানোর কসরত থেমে নেই।
এমন পরিস্থিতিতে কিছু কর্মকর্তাও রাজনৈতিক যোগসাজশের সন্ধান করছেন। কাক্সিক্ষত পদায়ন বা পদোন্নতির আশায় ধরনা দিচ্ছেন দলীয় ফোরামে। নিজের সুবিধা প্রশস্ত করতে ব্যাচমেট বা অধস্তনের ব্যাপারে মনগড়া অভিমতও দিচ্ছেন কেউ কেউ। বিশেষ করে এ মুহূর্তে সচিব পদে পদোন্নতির আশায় কয়েকজন অতিরিক্ত সচিব পছন্দের দলীয় শেল্টার তালাশ করছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ নতুন করে সুবিধা ও প্রভাব অনুযায়ী দলের জার্সি গায়ে লাগাতে ব্যস্ত।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ২৭ মার্চ থেকে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগে সচিব নেই। একইভাবে গত ২৭ আগস্ট এর পর থেকে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব পদ ফাঁকা। গত ২১ অক্টোবর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমানকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৬ অক্টোবর থেকে ফাঁকা রয়েছে বস্ত্র ও পাট সচিবের পদ। ১২ অক্টোবর থেকে খালি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের পদ। এসব স্থানে সচিব করা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বর্তমান সরকার। আবার আব্দুর রহমান তরফদারকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বাধার মুখে সচিবের চেয়ারে বসতে পারেননি তিনি। পরে পিএসসিতে চেয়ার পান। আরেকজন সচিব এসএম শাকিল আখতারের বেলায় চেয়ারও জোটেনি এখনও।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
সংশ্লিষ্টরা জানান, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের সচিব নিয়োগে বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। ডিসি নিয়োগ নিয়েও এখন দলীয় রেশারেশি চলছে। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনার সরকারের পতনের পর আশা করা হয়েছিল, দলীয় সিন্ডিকেট ভাঙবে। কিন্তু দেখা গেল অন্তর্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন দলের পরিচয়ে অনৈতিক চাপ আসতে থাকে। বঞ্চিত কর্মকর্তা দাবি করে প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তারা হাতাহাতিসহ ন্যক্কারজনক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন। এ সুযোগে নৈতিক স্খলন, দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মে শাস্তিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও বাগিয়ে নেন পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন। এখন সেই অবস্থা কমতে শুরু করলেও নির্বাচন সামনে রেখে পদোন্নতি-পদায়ন গুরুত্ব পেয়েছে দলগুলোর কাছে। বিভিন্ন দলের নেতারা নিরপেক্ষতার দাবি তুলে নিরপেক্ষ ব্যক্তির সুপারিশ করছেন প্রতিনিয়ত। ঠিক এ কারণেই গত ৯ অক্টোবর এপিডি উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব এরফানুল হককে সরাতে হয়। আবার রাজনৈতিক কারণে ওই শূন্যপদে এখনও কাউকে বসানো যায়নি। খুলনার বিভাগীয় কমিশনারের পদটিও একই দিন থেকে ফাঁকা। মাঠ প্রশাসনের ওই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন হয়নি গতকাল পর্যন্ত। মাঠ প্রশাসনে ডিসি পদায়ন নিয়েও একই দশা। উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও বদলিতেও চলছে দোটানা।
প্রশাসনের এই অবস্থা নিয়ে গতকাল আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার জন্য প্রধান উপদেষ্টা নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে এখন জনপ্রশাসন বা অন্য কোনো জায়গায় বড় বড় বদলির ব্যাপারটা তিনি নিজে দেখবেন।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী একই দিনে এক আলোচনা সভায় বলেন, নিরপেক্ষতা না থাকলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে, এটা সবাই জানে। বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা এ সরকারের বেশকিছু পদে পদায়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছেন। তাই যাঁদের নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অথবা যাঁরা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন অথবা যাঁরা কোনো দলের সঙ্ সম্পৃক্ত, তাঁরা সরকারে থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা ব্যাহত হতে পারে।