‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পাওয়া এক গ্রামপুলিশ

সাত বছরের চাকরিতে আলিশান বাড়ি কারখানাসহ কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা

সোহেল রানা, রাজবাড়ী
২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩৬
শেয়ার :
‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পাওয়া এক গ্রামপুলিশ

পেশায় তিনি গ্রামপুলিশ বা দফাদার। চাকরির বয়স মাত্র সাত বছর। মাসিক ভাতা আট হাজার টাকা। পারিবারিক বিষয় সম্পত্তিও তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু এই সাত বছরেই তিনি গড়ে তুলেছেন কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য। তিনি এখন হাট ইজরাদার, কেমিক্যাল কারখানার মালিক। চালান ইন্টারনেট ও ডিশ ব্যবসা, বড় আকারের গরুর খামার। তবে সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো বিষয় হচ্ছে তার আলিশান বাড়ি। এর নাম দিয়েছেন ‘ইহজাগতিক ভিলা’।

এই করিৎকর্মা লোকটির নাম মো. শহিদুল শেখ (২৫)। সামান্য এক দফাদার। কিন্তু অল্প দিনেই বিশাল উত্থান। এই গল্প এখন এলাকাবাসীর মুখে মুখে। এ যেন এক আলাদিনের চেরাগ। তবে কেউ জানেন না এর রহস্যটা কী। তার চেরাগ থেকে বেরিয়ে আসা ‘দৈত্যটার’ নাম কী। এ নিয়ে আছে নানা অনুমান।

শহিদুল শেখের বাড়ি রাজবাড়ী সদর উপজেলার শহীদ ওহাবপুর ইউনিয়নের সাদিপুর গ্রামে। তিনি গ্রামের চা দোকানি শাহজাহান শেখের ছেলে। শহীদ ওহাবপুর ইউনিয়ন পরিষদে দফাদারের চাকরি করেন। তবে নামমাত্র। ডিউটিতে যান না। বিপুল বিত্ত-সম্পদ নিয়ে তার নানা ব্যস্ততা। ফলে এখন দফাদারি চাকরিতে মন বসে না। তিনি এখন চাকরিটা ছাড়তে চান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রামপুলিশ শহিদুল শেখ বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেননি। পাশের কুঠিরহাট বাজারেই বাবার সঙ্গে চায়ের দোকান শুরু করেন। চায়ের দোকানটা আবার সরকারি খাসজমিতে গড়ে তোলা। এরই মধ্যে ২০১৮ সালে এসে তার নতুন পরিচয় যুক্ত হয়। ওই বছর শহীদ ওহাবপুর ইউনিয়ন পরিষদে গ্রামপুলিশের চাকরি হয়। ঘুরতে থাকে ভাগ্যের চাকা। একে একে

গড়ে তোলেন রাজবাড়ী জেলখানার পাশে একটি কেমিক্যাল কারখানা, ১৬ লাখ টাকার ইন্টারনেট ব্যবসা, কয়েক লাখ টাকার ডিশলাইনের ব্যবসা। ৫০টি গরু নিয়ে গড়ে তুলেছেন খামার। এরই মধ্যে ১৪ লাখ টাকায় কুঠিরহাটে গরুর হাট ইজারা নিয়েছেন। রয়েছে আরও কিছু ব্যবসা। এর মধ্যে ৩০ লাখ টাকার কৃষিজমি ক্রয় করেছেন। বাবার পুরনো চায়ের দোকান এখন ভাড়া দিয়েছেন। আর সাদিপুর গ্রামে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন দ্বিতল বাসভবন। ভাই জাহিদ শেখ ছিলেন ডেকোরেটরকর্মী। তাকে একটি ডেকোরেটরের দোকানের মালিক বানিয়ে দিয়েছেন।

কুঠিরহাট বাজারের কয়েকজন চায়ের দোকানির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, সামান্য চায়ের দোকান করে এত টাকার মালিক হওয়া অসম্ভব। আমরা চায়ের দোকান করে ঠিকমতো সংসার চালাতে পারি না, কষ্ট হয়। আর শহিদুল কোটি টাকা খরচ করে আলিশান বাড়ি বানিয়েছে। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে। বিষয়টি সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত।

শহীদ ওহাবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ ভুঁইয়া বলেন, গ্রামপুলিশ শহিদুল শেখ দীর্ঘদিন পরিষদে আসে না, কাজও করে না। তাকে শোকজ করা হয়। পরবর্তী কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

গ্রামপুলিশ মো. শহিদুল শেখের দাবি তিনি চায়ের দোকান থাকাবস্থায় বিকাশের ব্যবসা করতেন। করোনাকালীন সময়ে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। তবে আগে থেকেই ডিশলাইনের ব্যবসা ছিল। বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবসা, কেমিক্যাল ফ্যাক্টারি, কুঠিরহাট বাজারের গরুর হাটে ১৪ লাখ টাকার শেয়ার রয়েছে। ৯ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন। ৫০ লাখ টাকা খরচ করে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তবে এর মধ্যে অনেক টাকা ঋণ রয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন। এ ছাড়া তার স্ত্রী অনলাইনে কাঁথার ব্যবসা করেন।

শহিদুল শেখ জানান, গত ২ বছর আগে আয়কর ফাইল খুলেছেন। তিনি বলেন, আগে শূন্য রিটার্ন থাকলেও এখন কিছু টাকা দেখিয়েছি। ব্যস্ততার কারণে গ্রামপুলিশের চাকরির ডিউটি করতে পারি না। এখন চাকরি ছাড়তে চাই। কীভাবে ছাড়ব বুঝতে পারছি না। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শোকজ করেছিল। তার জবাব দিয়েছি।

গ্রামপুলিশ শহিদুল শেখের এই বিত্তবৈভব এবং তার চাকরিতে না যাওয়া প্রসঙ্গে জানাতে চাওয়া হয় রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মারিয়া হকের কাছে। তিনি বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজখবর নিয়ে দেখব।

এ ব্যাপারে রাজবাড়ী জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য সৌমিত্র শীল চন্দন বলেন, একজন গ্রামপুলিশের ৭ বছরের চাকরিতে এত টাকার মালিক হওয়ার সুযোগ নেই। অবশ্যই তার এই সম্পত্তি অর্জনের কোনো অবৈধ উৎস রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে দাবি জানাই, বিষয়টি তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।