পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভা স্থগিতে ৩৩ নাগরিকের উদ্বেগ

অনলাইন ডেস্ক
২০ অক্টোবর ২০২৫, ১৯:৩০
শেয়ার :
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভা স্থগিতে ৩৩ নাগরিকের উদ্বেগ

হরতালের হুমকিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভা স্থগিত করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মী, নাগরিক অধিকার কর্মীসহ দেশের ৩৩ জন বিশিষ্ট নাগরিক। সোমবার (২০ অক্টোবর) গণমাধ্যমকে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এই উদ্বেগ জানান।

এর আগে রোববার (১৯ অক্টোবর) রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কমিশনের এই বৈঠকের আগেই বৈঠক বাতিলের দাবিতে রাঙামাটির সচেতন ছাত্র-জনতার ব্যানারে হরতালের ডাক দেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ (পিসিসিপি)। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) রাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের পক্ষ থেকে এ বৈঠক স্থগিতের কথা জানানো হয়।

সোমবার বিশিষ্ট নাগরিকদের পাঠানো বিবৃতিতে তারা বলেন, আমরা গভীর ক্ষোভ, উদ্বেগ ও বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করছি, পার্বত্য তিন জেলায় ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন গঠিত হলেও গত ২৪ বছরে এ কমিশন বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে পারেনি। তবে ২০১৬ সালে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন সংশোধনের পর ভূমি কমিশনের কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যা বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ইতোমধ্যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে ছাব্বিশ হাজারের অধিক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির আবেদন জমা পড়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু এই বিরোধীয় বিষয়গুলি নিষ্পত্তির জন্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কার্যকর করতে একান্ত প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, এমনকি কমিশন পরিচালনার জন্য যথাযথ লোকবল এবং প্রয়োজনীয় বাজেটসহ অন্যান্য আনুসঙ্গিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। এর আগের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যানরাও এই সভা করার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এবং নব নিযুক্ত চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল হাফিজও সব পরিস্থিতি জানার পরও তথাকথিত নাগরিক পরিষদ ও তার ক্ষমতার পেছনের স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের হাতে জিম্মি হয়ে একই পথে চলে সভা অনুষ্ঠান না করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

বিবৃতিতে নাগরিকেরা বলেন, এখানে লক্ষনীয় সরকারের ভেতরের একটি প্রভাবশালী মহল প্রচ্ছন্নভাবে, কখনো কখনো প্রকাশ্যে এই চুক্তি বিরোধীদের সহিংস ও ধংসাত্মক তৎপরতায় ইন্ধন যুগিয়ে আসছে বলে অনেক দিন থেকেই অভিযোগ রয়েছে। তাদেরই মদদে এই কথিত নাগারিক পরিষদ সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের নির্ধারিত সভা বাতিলের জন্য রাঙামাটি সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে অবরোধের হুমকি দিয়েছে। আর এই উছিলায় ১৯ অক্টোবরের পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের পূর্ব নির্ধারিত সভা স্থগিত করা হয়েছে। আমরা চুক্তি বিরোধী তথাকথিত নাগরিক পরিষদের নাশকতাপূর্ণ তৎপরতা এবং ভূমি কমিশনের সভা স্থগিত করার সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশাসনের আইন শৃংখলা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের চুক্তি বিরোধীদের ব্যাপারে নমনীয় এবং দৃশ্যত ও বাস্তবে সহায়ক ভূমিকার কঠোর প্রতিবাদ জানাই।

বিবৃতিতে বলা হয়, ভূমি বিরোধের জেরে একের পর এক পাহাড়ি গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, পাহাড়ি নারীদের ওপর নির্যাতন, ধর্ষণসহ পাহাড়িদের হত্যা, অপহরণ, মিথ্যা মামলা, হয়রানি ক্রমেই এই জনপদকে নিরাপত্তাহীনতা ও শঙ্কার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। দেশের অন্যান্য যেকোনো অংশের চাইতে নিরাপত্তার নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে একের পর এক সেনানিবাস ও দুই শতাধিক সেনা ক্যাম্প স্থাপন করার পরেও এই অঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতা ও শঙ্কার মাত্রা দিন দিন শুধু বৃদ্ধিই পাচ্ছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এটি দিবালোকের মতো পরিস্কার যে পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা ভূমি বিরোধের স্থায়ী সমাধান না করে এবং অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত না করে দিনের পর দিন নিরাপত্তার চশমা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসীদের বঞ্চনার সমস্যাকে বার বার শুধু উপেক্ষা করে সেটলার অপাহাড়িদের মধ্যে কিছু লোককে বা একটি সহিংস গোষ্ঠীকে তাদের ওপর হামলা, নির্যাতন চালাতে উৎসাহ ও ইন্ধন দিয়ে এবং যেকোনো ঘটনায় পাহাড়িদের ওপরই দোষ চাপিয়ে গুলি, হত্যা, গ্রেপ্তারের নিপীড়নের শিকার বানিয়ে সমস্যাকেই কেবল জটিল করে তোলা হচ্ছে। আর স্থানীয় পাহাড়িসহ সাধারণ নাগরিকদের দুর্ভোগের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

বিবৃতিদাতারা বলেন, আমরা তাই পার্বত্য তিন জেলায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের নির্ধারিত সভা অনুষ্ঠানে বার বার কারা বাধা দিচ্ছে, আর কেন একই অজুহাতে সভা স্থগিত করা হচ্ছে উচ্চ পর্যায়ের স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে তার কারণ উদঘাটন করার জোর দাবি জানাচ্ছি। একই সাথে সরকারের ভেতরের কোনো প্রভাবশালী মহলের এতে কোনো ইন্ধন ছিল বা আছে কি-না তাও সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা এবং দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে জবাবদিহির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

মনে রাখা জরুরি যে, সরকার বা সরকারের কোনো প্রভাবশালী মহলই শুধু পার্বত্যবাসী নয় সমগ্র দেশবাসীর কাছে তার যেকোনো কাজ এবং অনভিপ্রেত আচরণের জবাবদিহির দায় কোনো অজুহাতেই এড়াতে পারে না। ২৪-এর জুলাই অভুত্থান সেই বার্তাই সবাইকে আর একবার দৃঢ়ভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতারা হলেন সুলতানা কামাল, খুশী কবির, শিরীন পারভীন হক, শাহীন আনাম, ইফতেখারুজ্জামান, শামসুল হুদা, তবারক হোসেন, সালমা আলী, সুব্রত চৌধুরী, ফেরদৌস আজীম, জাকির হোসেন, খাইরুল চৌধুরী, তাসলিমা ইসলাম, তাসনীম সিরাজ মাহমুব, জোবাইদা নাসরীন, রেজওয়ানা করিম, মোশরেকা অদিতি হক, ফারহা তানজীম, পারভেজ হাসেম, রেজাউল করিম চৌধুরী, দীপায়ন খীসা, মনিন্দ্র কুমার নাথ, পল্লব চাকমা, সালেহ আহমেদ, সাইদুর রহমান, সাইফুর রহমান, মাহাবুবুল হক, পাভেল পার্থ, শাহেদ কায়েস, মেইনথিন প্রমীলা, সাঈদ আহমেদ, হানা শামস আহমেদ ও মুক্তাশ্রী চাকমা।

আমাদের সময়/আরডি