পোশাক ও ওষুধ শিল্পে বড় ক্ষতি

সবার সহযোগিতা চান ওষুধ কোম্পানির মালিকরা ।। পোশাক খাতের ক্ষতির তথ্য সংগ্রহে পোর্টাল চালু

মুহম্মদ আকবর
২০ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৪০
শেয়ার :
পোশাক ও ওষুধ শিল্পে বড় ক্ষতি

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ওষুধশিল্প ও তৈরি পোশাক খাতে কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। পোশাকশিল্পে শত কোটি টাকার বেশি ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুধু ওষুধশিল্পেই ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।

ওষুধশিল্পে বড় ধাক্কা বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ও ডেল্টা ফার্মা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মো. জাকির হোসেন বলেন, কার্গো গুদামে অগ্নিকাণ্ডে দেশের ওষুধশিল্প বড় ধরনের ধাক্কায় পড়েছে। শুধু ফার্মাসিউটিক্যাল খাতেই কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে। তিনি জানান, ডেল্টা ফার্মার সাতটি কনসাইনমেন্ট পুড়ে গেছে। কাঁচামালের প্রাথমিক মূল্য প্রায় ৪.৫ লাখ ডলার (প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা), ডিউটি ও ট্যাক্সসহ যা ৫ কোটি টাকার বেশি। তিনি জানান, তাঁদের কোম্পানির সাতটি কনসাইনমেন্ট এরই মধ্যে ঢাকায় ল্যান্ড করেছিল, আরেকটি কলকাতায় ফিরে গেছে।

ওষুধ সমিতির নেতা মো. জাকির হোসেন নিজের প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বলেন, বড় কোম্পানিগুলোর ক্ষতির পরিমাণ ১৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার মধ্যে হতে পারে। র-ম্যাটেরিয়াল (কাঁচামাল) থেকেই তো প্রোডাক্ট বানিয়ে মার্কেটে দেওয়া হয়। এখন সাপ্লাই চেইনে ক্রাইসিস আসবেই। হয়তো আজ না, কিন্তু ১৫-২০ দিনের মধ্যে এর প্রভাব বাজারে দেখা যাবে। সমিতির পক্ষ থেকে

সদস্য কোম্পানিগুলোর ক্ষতির হিসাব সংগ্রহ শুরু হয়েছে। তবে ক্ষতির সম্পূর্ণ পরিমাণ জানাতে আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জাহিদ হোসেন জানান, গতকাল পর্যন্ত গুদামে প্রবেশের সুযোগ ছিল না। রোববার সকালে থেকে আমরা এলসি, এয়ারওয়ে বিল, কাস্টমস রেকর্ড দেখে প্রাথমিক হিসাব তৈরি করছি। তিনি জানান, এরই মধ্যে ইনস্যুরেন্স ক্লেইম, কাস্টমস নোটিফিকেশন, নতুন এলসি খোলাসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া এখন জটিল হয়ে গেছে। আবার কিছু পণ্য নারকোটিক্স আইটেম হিসেবে ড্রাগ কন্ট্রোল অথরিটি ও এনবিআরের অনুমতির আওতায় পড়ে, সেগুলোর পুনরায় অনুমোদনও লাগবে।

স্কয়ার ও ইনসেপ্টার ক্ষতি

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা আলম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জানান, প্রাথমিক হিসাবে তাঁদের ক্ষতি ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকার মধ্যে হতে পারে। এর মধ্যে ১২-১৩ কোটি টাকার কাঁচামাল এবং টেক্সটাইল খাতে আড়াই কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা এরই মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছি। নতুন করে কাঁচামাল পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাই ওষুধ সরবরাহে বড় কোনো ঘাটতি হবে না।

ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের জিএম (প্রশাসন) জাহিদুল আলম জানান, তাঁদের প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে সাপ্লাই চেইন শক্তিশালী হওয়ায় সংকট সরাসরি বাজারে তেমন প্রভাব ফেলবে না বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, আমাদের সাপ্লাই চেইন খুবই শক্তিশালী। দ্রুত ইনিশিয়েটিভ নিলে এটা ওভারকাম করা সম্ভব। আমাদের স্টকও আছে, তাই বাজারে তেমন প্রভাব পড়বে না।

জীবনরক্ষাকারী ওষুধের কাঁচামাল নষ্ট

ফার্মাসিউটিক্যালস খাতের সংশ্লিষ্টরা জানান, চীন, ভারত ও জার্মানি থেকে আসা অন্তত ২০টি শিপমেন্টে থাকা প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার কেজি কাঁচামাল নষ্ট হয়েছে। রবিবার থেকে এসব পণ্য খালাসের কথা ছিল। এসব দিয়ে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জীবনরক্ষাকারী ওষুধ তৈরি করা হতো। এরিস্ট ফার্মা, হেলথকেয়ার, বেক্সিমকো ফার্মাসহ অনেক ছোট-বড় কোম্পানির কাঁচামাল পুড়ে শেষ হয়ে গেছে বলে জানান তাঁরা।

পোশাক খাতে শত কোটি টাকার ক্ষতি

তৈরি পোশাক কারখানার কাঁচামাল, প্রস্তুত পণ্য ও স্যাম্পল পুড়ে যাওয়ায় পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইনামুল হক খানের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল গতকাল রবিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায়। পরে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

সভাপতি ইনামুল হক খান জানান, সাধারণত উচ্চ মূল্যের পণ্য এবং জরুরি শিপমেন্টের ক্ষেত্রে আকাশপথে জাহাজীকরণ করা হয়। অগ্নিকাণ্ডের ফলে তৈরি পোশাক, মূল্যবান কাঁচামাল এবং নতুন ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্যাম্পল পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আগুনে যে পরিমাণ পণ্য নষ্ট হয়েছে, তা শুধু বর্তমান রপ্তানির ক্ষতি নয়, ভবিষ্যতের ব্যবসায়িক সুযোগও ব্যাহত করবে।

বিজিএমইএ ক্ষতির সুনির্দিষ্ট হিসাব করতে সদস্যদের কাছ থেকে তালিকা নিচ্ছে এবং দ্রুত কাজের জন্য অনলাইন পোর্টাল চালু করেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ শেষে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যৌথ সমন্বয় সভা করবে সংগঠনটি।

বিজিএমইএর পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেনÑ আমাদের অনুমান, ক্ষতির পরিমাণ ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) টাকার বেশি হতে পারে। বাণিজ্য উপদেষ্টা নতুন পণ্য আমদানি ও দ্রুত পণ্য খালাসে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

সামগ্রিক ক্ষতি কয়েক হাজার কোটি টাকার আশঙ্কা

ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএইএবি) সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, কার্গো ভিলেজে আগুনে বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতি হতে পারে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, ওয়্যারহাউস ও এয়ার এক্সপ্রেস ইউনিট পুড়ে যাওয়ায় ক্ষতির মাত্রা ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে। অসতর্কতা নাকি অবহেলার কারণে আগুন, তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

ভবিষ্যতে প্রভাব ও উদ্বেগ

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীরা বড় ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। তবে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে আরও সময় লাগবে।