জীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস পাইপলাইনে কোটি কোটি টাকার অপচয়
দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাসের পাইপলাইনগুলো হয়ে উঠেছে মানুষের জন্য ভয়াবহ মরণফাঁদ। জরাজীর্ণ ও অর্ধশতাব্দীর পুরনো এই পাইপলাইনে প্রতিদিন গ্যাস লিকেজের ঘটনা ঘটছে, যার ফলে একদিকে অপচয় হচ্ছে শত শত মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, অন্যদিকে রাজধানী ও আশপাশের এলাকাগুলোয় বেড়েছে বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি। পাইপলাইনের ছিদ্র মেরামতে তিতাস নিরন্তর চেষ্টা করলেও সিস্টেম লস ও অপচয়ের হার দিনদিনই বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরনো পাইপলাইন ও পরিকল্পনাহীন উন্নয়নকাজের কারণে এখন পুরো তিতাস নেটওয়ার্কই হয়ে উঠেছে একটি অদৃশ্য মৃত্যুফাঁদ।
দেশের গ্যাস বিতরণব্যবস্থার ৮০ ভাগই গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (তিতাস)। কিন্তু বিশাল এলাকাজুড়ে গ্যাসের পাইপলাইনে লিকেজ নিয়ে মহাসংকটে পড়েছে কোম্পানিটি। তিতাস বলছে, পাইপলাইনে লিকেজের কারণে শত মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উধাও হয়ে যাচ্ছে। সেই দায় সিস্টেম লস হিসেবে তিতাসের ঘাড়ে চাপছে। তিতাসের কর্মকর্তারা বলেছেন, যত বেশি গ্যাস তাঁদের নেটওয়ার্কে ঢোকে, তত বেশি সিস্টেম লস বাড়ে। আবার গ্যাস সরবরাহ কমলেও গ্রাহকরা ঠিকমতো গ্যাস পান না। ফলে পাইপলাইন লিকেজের কারণে কোম্পানিটি বড় সংকটে পড়েছে। প্রতিনিয়ত নানা জায়গায় ঘটছে দুর্ঘটনা। আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে হাজার কোটি টাকা।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ পারভেজ এ বিষয়ে বলেন, তিতাসের গ্যাস নেটওয়ার্ক অনেক বিশাল এবং পুরনো। কোনো কোনো পাইপলাইন ৫০ বছরের পুরনো। এগুলো জরাজীর্ণ থাকায় এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলায় তিতাসের পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে পাইপলাইনে ছিদ্র রয়েছে। গ্যাসের চাপ বাড়লে ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বের হয়। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি পাইপলাইনের ছিদ্র চিহ্নিত করে মেরামত করতে। এ ছাড়া অনেক পুরনো পাইপলাইন পরিবর্তনের লক্ষ্যেও একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।
তিতাস সূত্রে জানা যায়, জানুয়ারি ২৪ থেকে জুলাই ২৫ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইন জরিপ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৫৬৮টি লিকেজ চিহ্নিত করা হয়। সাড়ে ৬ হাজার লিকেজ মেরামত করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৬১ গ্যাস স্টেশনের সিজিএস, টিভিএস এবং ডিআরএসগুলোয় লিকেজ পাওয়া গেছে ৫০৫টি, মেরামত হয়েছে ৪৯২টি। আর গ্রাহক প্রান্তে অভ্যন্তরীণ লাইনে গ্যাসের লিকেজ পাওয়া গেছে সাড়ে ৩ হাজার, মেরামত হয়েছে ৩ হাজার ৪০০। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে গত এক বছরে প্রায় ১২ হাজার ১০৩টি ছিদ্রসংক্রান্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১১ হাজার ৫৪০টি মেরামত করা হয়েছে।
এদিকে তিতাসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস। দেশের মোট যে গ্যাস ব্যবহার হয় তার সিংহভাগ বিতরণ হয় তিতাস এলাকায়। তিতাসের গ্যাস নেটওয়ার্ক লাইনও অনেক বড় এবং বিস্তৃত। তিতাসের আওতাধীন এলাকায় গ্যাসের সরবরাহ ১ হাজার ৮০০ মিলিয়ন
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
ঘনফুট যদি হয়, তবে গ্রাহকের গ্যাস প্রাপ্তি নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ থাকে না। কম করে হলেও কোথাও গ্রাহক গ্যাস পান, কোথাও পর্যাপ্ত সরবরাহ হয় না। তিতাস এক অদ্ভুত সমস্যায় পড়েছে। তিনি আরও বলেন, পেট্রোবাংলা থেকে গড়ে তিতাসে প্রতিদিন ১ হাজার ১০০ থেকে সাড়ে ১ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে, তিতাসের পাইপলাইনে বেশি গ্যাস সরবরাহ করা হলে গ্যাসের সিস্টেম লসও বেড়ে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে, কিন্তু নিট বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট। সিস্টেম লস হয়েছে ১১ মিলিয়ন। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত গড়ে ১ হাজার ২০০ থেকে সাড়ে ১ হাজার ৩৫০ ঘটফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এ সময় গড়ে সিস্টেম লস হয়েছে সাড়ে ৭ থেকে ৯ শতাংশ। কিন্তু জুলাই মাসে গ্যাস সরবরাহ হয়েছে সাড়ে ১ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ওই মাসে সিস্টেম লস হয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ, অর্থাৎ ১৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের অপচয় হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা ধারণা করছি, গ্যাসের প্রেসার বেশি থাকলে পাইপলাইনে গ্যাসের চাপও বেশি থাকে, ফলে বেশি করে গ্যাস বেরিয়ে অপচয় বাড়ছে।
তিতাসের অপারেশন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, তিতাসের গ্যাস নেটওয়ার্ক এমন ছিদ্র এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। জরাজীর্ণ পাইপলাইন, দীর্ঘ দিনের পুরনো পাইপলাইনে মরিচা ধরা, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় যেভাবে ছিদ্র করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেওয়া হচ্ছে, তার কারণে তিতাসের পাইপলাইনের নেটওয়ার্ক প্রায় ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তিনি বলেন, তিতাসের অনুমোদন ছাড়া যেখানে-সেখানে পাইপলাইন স্থাপন করার কারণে এখন তিতাসের পাইপলাইন নেটওয়ার্কও তিতাস কর্তৃপক্ষের অজানা। এ ছাড়া তিতাসের অধিকাংশ পাইপলাইন প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বছরের পুরনো হওয়ায় গ্যাস সরবরাহ পাইপলাইন এখন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীজুড়ে বছরের পর বছর বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির উন্নয়ন প্রকল্প চলাকালেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তিতাসের পাইপ। ফলে পাইপলাইন ছিদ্রের কোনো সঠিক হিসাব নেই কর্তৃপক্ষের কাছে।
তিতাসের আওতাধীন এলাকায় মাটির নিচে থাকা গ্যাস বিতরণ পাইপলাইনের অসংখ্য ছিদ্রের কারণে যে কোনো সময় ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তিতাস সূত্রে জানা যায়, তিতাস বেশ কয়েক বছর ধরে পাইপলাইন পরিবর্তনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে এখনও সেটা চূড়ান্ত হয়নি। সূত্র জানায়, নতুন পাইপলাইন প্রকল্পে তিতাসের গ্যাস নেটওয়ার্ককে একটি স্মার্ট নেটওয়ার্ক হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে স্ক্যাডা সিস্টেম, জিপিএস সংযুক্ত করা হবে। এ ছাড়া যেসব এলাকায় পাইপলাইনের ডায়া চিকন, সেখানে মোটা পাইপলাইন স্থাপন করা হবে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
তিতাস সূত্রে আরও জানা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পাইপলাইন পরিবর্তনে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। এ প্রকল্পের বাইরেও তিতাস ঢাকা-টাঙ্গাইল, এলেঙ্গা-মানিকগঞ্জ, মানিকগঞ্জ-সাভার, ঢাকা-জয়দেবপুর, ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে রাস্তার দুই পাশে পাইপলাইন প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, দেশের গ্যাস বিতরণের ৮০ ভাগ করে তিতাস। এর আওতাধীন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকারখানা, শিল্পাঞ্চল। পাইপলাইন নিয়মিত সংস্কারের বিষয়- এতদিনে কেন করা হয়নি, তাও একটা প্রশ্ন। তিনি বলেন, এখন পাইপলাইনে বিশেষ করে আবাসিক খাতে গ্যাসের সংযোগ বন্ধ। ফলে পাইপলাইন নতুন করে স্থাপনের আগে ভাবতে হবে, যদি সরকার আবাসিকে আর গ্যাস সংযোগ না দেয়, সেক্ষেত্রে পাইপলাইনে বড় বিনিয়োগ করবে কি না।
পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, দেশের বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। কোম্পানিটির বর্তমান গ্রাহক ২৮ লাখ ৭৭ হাজার ৬০৪। এ কোম্পানি বর্তমানে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জসহ ১৬টি জেলায় গ্যাস সরবরাহ করছে।
১৯৬৮ সালের ২৮ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম গ্যাস সরবরাহ শুরু করে। ওই সময় সীমিত আকারে ঢাকায় বাসাবাড়িতেও গ্যাস সরবরাহ করে কোম্পানিটি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল থেকে পাইপলাইনের পরিধি বাড়তে থাকে। বর্তমানে পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য ১৩ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের অধিকাংশই ৪০ বছরের পুরনো। সাধারণ পাইপলাইনের আয়ুষ্কাল ধরা হয় ৩০ বছর।
পেট্রোবাংলার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে তিতাস গ্যাসের নেটওয়ার্কের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ। অধিকাংশ পাইপলাইন মাটির গভীরে চলে গেছে। এ ছাড়া রাজধানীতে নানা সংস্থার উন্নয়নকাজের সময় পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সরবরাহ লাইনে আসলে ছিদ্রের সংখ্যা কত, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। গ্রাহকরা অভিযোগ করলে গ্যাসের ছিদ্রের কথা জানা যায়।
পাইপলাইনে ছিদ্র শুধু গ্যাসের অপচয় বা সিস্টেম লসের বিষয় নয়, এটি মানুষের মৃত্যুফাঁদেও পরিণত হয়েছে। একটি পরিত্যক্ত পাইপলাইনের ছিদ্র থেকে ২০২০ সালে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে একাধিক বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণে মারা যান ৩৪ জন। এ ছাড়া মগবাজারে একটি ভবনে বিস্ফোরণে মারা যান সাতজন। বিচ্ছিন্ন করা পাইপলাইন সংযোগ থেকে গ্যাস জমে এই দুই দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় ও সিদ্দিকবাজারে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনাও গ্যাসের পরিত্যক্ত লাইনের লিকেজ থেকে হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই দুই বিস্ফোরণে মারা যায় ৩২ জন। নারায়ণগঞ্জের আদমজি ইপিজেডে একটি কারখানা নির্মাণকালে বড় ধরনের পাইপ ছিদ্র হয়ে আগুন ধরে যায়। এ ছাড়া একের পর এক দুর্ঘটনা এখন নিয়মিত ঘটনা।