মিথ্যা মামলায় বিপর্যস্ত এক মা

প্রতিশোধ নিতে ফাঁসানোর দাবি লিজার

রহমান জাহিদ
১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:২৫
শেয়ার :
মিথ্যা মামলায় বিপর্যস্ত এক মা

রাজধানীর কদমতলীর এক গলির ভেতর ছোট্ট ভাড়া বাসায় থাকেন ফাহিমা বেগম লিজা (৪৫)। দুই সন্তানের মা এই নারী একসময় সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতেন। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই, এমনকি রাজনীতি সম্পর্কেও বিশেষ আগ্রহ ছিল না তাঁর। অথচ এখন তিনি আসামি হয়েছেন আলোচিত জুলাই ছাত্র আন্দোলনের একটি হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায়।

মামলার কাগজে তাঁর পরিচয় দেওয়া হয়েছে- বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। এতে লিজা বিস্মিত ও বিধ্বস্ত। তিনি বলেন, আমি কোনো দিন রাজনীতি করিনি। হঠাৎ করেই জানতে পারলাম, আমার নামে মামলা হয়েছে। তাও আবার আমি নাকি যুব মহিলা লীগের নেত্রী!

অভিযোগের পেছনে ব্যক্তিগত বিরোধ

লিজার দাবি, মামলার পেছনে রয়েছে তাঁর সাবেক স্বামী-আইনজীবী মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম আকাশ। প্রথম স্বামী বিদেশে অবস্থানরত অবস্থায় মারা যাওয়ার পর এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তাঁকে বিয়ে করেন লিজা।

ঢাকা জজকোর্টে আসা-যাওয়ায় আইনজীবী আকাশের সঙ্গে পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে তিনি তাঁকে বিষয়ের প্রস্তাব দেন। বিয়ের পর তিনি ৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা নেন। এরপর যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে তাঁর (আকাশ) বিরুদ্ধে দেনমোহার ও খোরপোষের একটি, যৌতুক আইনে একটি এবং একটি চেক ডিজঅনারের মামলা করেন। আর আইনজীবী আকাশ তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে ছয়টি মামলা করেছেন। এসব মামলায় তিনি খালাস পেয়েছেন। তবে তাঁর করা তিনটি মামলার মধ্যে যৌতুক আইনের মামলায় আইনজীবী আকাশের ১ বছরের কারাদণ্ড, চেকের মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং দেনমোহার ও খোরপোষের মামলায় তিনি ২৭ লাখ টাকার ডিক্রি পেয়েছেন। ৩ মামলায় দণ্ডিত হওয়ার কারণে এখন প্রতিশোধ নিতে মিথ্যা মামলায় ফাঁসাচ্ছে।

লিজা বলেন, আকাশই বাদী রাব্বি কাজীকে ব্যবহার করে তাঁকে ফাঁসিয়েছেন। মামলার বাদী হিসেবে যে ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে, সেটি আইনজীবী আকাশের নিজের নম্বর, যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে মামলার সত্যতা নিয়েও।

মামলার পটভূমি

চলতি বছরের ২৯ মে ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলাটি করেন মো. রাব্বি কাজী নামের এক তরুণ, যার সিআর মামলা নং-৩৪৬/২০২৫ (কদমতলী আমলী)। মামলায় তাঁর পরিচয় চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ থানার নওগাঁও গ্রামের রিপন কাজীর ছেলে। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ৫৩৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। লিজা ১৩ নম্বর আসামি।

বাদী দাবি করেছেন, গত বছরের ২০ জুলাই কদমতলীর মেরাজ নগর এলাকায় ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত ‘সন্ত্রাসীরা’ হামলা চালায়- এমন অভিযোগ মামলার এজাহারে রয়েছে। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্ট্রিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মাদ মনিরুল ইসলাম আকাশ ঢাকা আইনজীবী সমিতির বিএনপি ঘরানার আইনজীবী হিসেবে পরিচিত।

বিতর্কিত সংযোগ

মামলার বাদী রাব্বি কাজীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে দেখা যায়, মামলায় দেওয়া তাঁর মোবাইল নম্বরটি আইনজীবী আকাশের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আকাশ বলেন- ‘বাদীর ফোন নম্বর ছিল না, তাই আমারটা দিয়েছি।’ একই সঙ্গে তিনি লিজার সাবেক স্বামী হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি তাঁকে চিনি না। মিথ্যা কথা বলছে।’

দুই সন্তানের মা লিজা আজ দিশাহারা। একের পর এক মামলা, থানায় হাজিরা, আদালতের ধকল- সব মিলিয়ে তাঁর জীবন ভেঙে পড়েছে। তবু তিনি হার মানেননি। তিনি বলেন, আমি শুধু সত্যের বিচার চাই। আমার নামটা যেন মুছে যায় এই মিথ্যা মামলার তালিকা থেকে।