ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিয়ে শঙ্কা
ভস্মীভূত কয়েক হাজার কোটি টাকার পণ্য
দেশের বিমানবন্দরগুলোতে ৫০ বছরেও গড়ে ওঠেনি আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। গতকাল ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউসের অগ্নিকাণ্ডে কয়েক হাজার কোটি টাকার পণ্য পুড়ে গেছে। এই অগ্নিকাণ্ডে কর্তৃপক্ষের অবহেলা দেখছেন ভুক্তভোগীরা। আমদানি করা কয়েক হাজার কোটি টাকার এসব পণ্যের পরিণতি জানেন না মালিকরা। পণ্য পুড়ে গেলে তার ক্ষতিপূরণ পাবেন কিনা, তা নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন তারা। এই ক্ষতির পাশাপাশি বিমানবন্দরের সুরক্ষা শ্রেণিতে অবনতি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিমানবন্দরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিমানবন্দরে ভয়াবহ আগুনে আমদানি করা শত শত টন পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এতে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। আগুন পুরোপুরি না নেভা পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যাবে না। এ ঘটনায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন আমদানিকারকরা। বীমা দাবি করে এসব পণ্যের ক্ষতিপূরণ আদায় করাও বেশ সময়সাপেক্ষ বিষয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ ধরনের আগুন লাগা এবং তা নিয়ন্ত্রণে আনার সময় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ বন্দোবস্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। এতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সুরক্ষা শ্রেণিতে অবনতি হতে পারে।
আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শাহজালালে আমদানি-রপ্তানির জন্য ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্ট হিসাবে কাজ করে ২ হাজার ২০০টি প্রতিষ্ঠান। হাজার হাজার কোটি টাকার মালামাল প্রতিমাসে আমদানি-রপ্তানি হয়। তাদের আমদানি করা মালামাল পুড়ে গেছে। আবার কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন সেটা তারা জানেন না। ক্ষতিপূরণ কীভাবে পাবেন সেটা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। লিমন হোসেন নামের একজন ব্যবসায়ী জানান, চীন থেকে সাত কোটি টাকার জুতা, ব্যাগ,
গার্মেন্টস পণ্য আমদানি করেছিলেন। এসব মালামাল দেশের বিভিন্ন জেলার ডিলারের কাছে তিনি পাইকারি বিক্রি করেন। রবিবার মালামাল বের করার কথা ছিল। তার আগেই সব ছাই হয়ে গেছে। তার পুরো ব্যবসার পুঁজি শেষ হয়ে গেছে। তিনি সরকার ও কর্তৃপক্ষের কাছে সহযোগিতা চান।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
সাবিয়া ছবি নামে একজন নারী জানান, চার সপ্তাহ আগে লন্ডন থেকে তার ৪৫ কেজি মালামাল শাহজালাল বিমানবন্দরে আসে। সময় দীর্ঘ হলেও মালামাল ছাড়াতে পারেননি। দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ জানায় কমিশনার চেঞ্জ হয়েছে, সে জন্য কাস্টমস ক্লিয়ার হয়নি। তিনি এখনও জানেন না তার জিনিস আছে, না নেই। সেগুলো পুড়ে গেলে কী হবে তাও জানেন না।
আকাশপথে পণ্য পরিবহনকারী আরএমকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জামান ইবনে আমিন সোহাইল বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর বোঝা যাবে কোন কোন আমদানিকারকের পণ্য পুড়েছে। সেই অনুযায়ী বীমা দাবিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে বেশ কয়েক জন আমদানিকারক তাদের পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) একজন কর্মকর্তা বলেন, আমদানির কার্গো হাউসে আগুন লাগায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর বোঝা যাবে ক্ষয়ক্ষতি কত হয়েছে, কবে নাগাদ আবার কার্গো হাউস চালু করা যাবে।
বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বিমানবন্দরের ফায়ার সেফটি বেহাল। ফায়ারের গাড়ি মেরামত ও আধুনিকায়ন হয়নি। দুই মাস আগে বেবিচকের চেয়ারম্যান বরাবর ফায়ার সেফটি ঠিক করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। তাতে জানানো হয়, শাহজাহাল বিমানবন্দরে অগ্নিনির্বাপণের জন্য মাত্র ৪টি গাড়ি আছে। তার মধ্যে একটি গাড়ি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। চটগ্রামে ৫টি, কক্সবাজারে ৩টি, সিলেটে ৪টি এবং বরিশাল, সৈয়দপুর ও রাজশাহীতে ২টি করে গাড়ি আছে। তবে গাড়ির একটি অংশ কাজ করে না।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
তিনি বলেন, আগুন লাগলে বিমানবন্দরগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করতে পারে। কিন্তু কোনো বিমানবন্দরেরই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নেই। ওই ব্যবস্থা থাকলে আগুন লাগলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি বের হবে। এ ছাড়া আগুন নেভানোর বোমের বিস্ফোরণ হবে। ফলে তাৎক্ষণিক আগুন নিভে যাবে। এ ছাড়া বিমানবন্দরগুলোতে আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি নেই। ফলে পানির অভাবে দ্রুত আগুন নেভানো সম্ভব হয় না।
বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তা বলেন, আগুন লাগার পর দ্রুত দক্ষিণ দিকে ছড়াচ্ছিল। কিছুদূর গেলেই টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে আগুন ধরে যেত। কোথাও কোনো মাউন্টেড ওয়াটার হোস দেখা গেল না। খুবই দুঃখজনক, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফায়ার ফাইটিং অবস্থা এতটাই নাজুক। আগুন জ্বলে পুরো কার্গো হাউস ছাই করে দিল।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শাহজালাল বিমানবন্দরে ফায়ার সেফটির বিষয়টি উপেক্ষিত ছিল। এখানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্সের পুরো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পাঁচ বছর ধরে অচল পড়ে আছে। ছয়টি ফায়ার পাম্প, ফোম লাইন ও ধোঁয়া শনাক্তকরণ যন্ত্র সচল না থাকায় কোটি কোটি টাকার বিমান, যন্ত্রাংশ ও শতাধিক কর্মীর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ।
ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা, খতিয়ে দেখতে হবে
কার্গো হাউসে অগ্নিকাণ্ড কেবল দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছেÑ খতিয়ে দেখতে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত তদন্ত শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। গতকাল শনিবার তাৎক্ষণিক এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান।
বিকেএমইএর সভাপতি বলেন, গত কয়েক দিনে স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী একাধিক পোশাক কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। কার্গো হাউসের মতো স্পর্শকাতর একটি জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে যে, এটি কতটা অনিরাপদ। গত কয়েক বছর ধরেই আমরা রপ্তানিকারকরা অভিযোগ করে আসছি, আমাদের পণ্য খোলা জায়গায় রাখা হয়Ñ যা নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। চট্টগ্রাম ইপিজেডে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের পর কার্গো হাউসে এ ধরনের ঘটনা আমাদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে নিরাপত্তা বিষয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতি বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি করতে পারে।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কার্গো হাউস ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশ হলো তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা, যারা তুলনামূলকভাবে হালকা যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিক পণ্যের আমদানি এবং তৈরি পোশাক ও নমুনা পাঠানোর কাজে এটি ব্যবহার করে থাকেন। আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসগুলোও এই কার্গো হাউসের মাধ্যমে তাদের গ্রাহকদের দলিলপত্র ও পার্সেল আকাশপথে আদান-প্রদান করে। এ ছাড়া ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তারা কাঁচামাল আমদানির জন্য এবং কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকরাÑ বিশেষ করে শাকসবজি ও অন্যান্য পচনশীল পণ্য রপ্তানির জন্য এই কার্গো হাউস ব্যবহার করেন। আমাদের রপ্তানিকারকদের ক্ষতির পরিমাণ এই মুহূর্তে নির্ধারণ করা কঠিন। তবে সম্পূর্ণ তদন্ত শেষে সামগ্রিক ক্ষতির চিত্র পাওয়া যাবে। আমরা বিকেএমইএর সদস্যদের কাছে একটি চিঠি পাঠাব, যাতে তারা তাদের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য আমাদের কাছে জমা দিতে পারেন।