কার্গো হাউস পুড়ে ছাই

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২৫
শেয়ার :
কার্গো হাউস পুড়ে ছাই

ভয়াল আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউস। পুড়ে গেছে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত শত শত টন মূল্যবান মালামাল। অগ্নিকাণ্ডের জেরে এ বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ চলাচল সাময়িক স্থগিত রাখা হয়। এতে করে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বিমান চলাচলের শিডিউল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকামুখী ফ্লাইটগুলো চট্টগ্রাম ও সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। কার্গো হাউসের মালামালের মধ্যে দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন ভয়ানক রূপ নেয়। আগুন থেকে রক্ষায় বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার থেকে উড়োজাহাজ সরিয়ে নেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের ৩৬টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সিভিল এভিয়েশন, বিমানবাহিনীর ফায়ার ইউনিটসহ সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরা। দুই প্লাটুন বিজিবিও এতে অংশ নেয়। জানা গেছে, ৬ ঘণ্টা পর, রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পুরোপুরি নির্বাপণ করা সম্ভব হয়নি। ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সরকার। 

অগ্নিকাণ্ডের কারণে শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়। এতে করে হাজার হাজার যাত্রী পড়েন ভোগান্তিতে। পূর্বনির্ধারিত শিডিউলের বিদেশগামী যাত্রীরা বিমানবন্দরের মূল ফটক ও আশপাশে অবস্থান করেন। পরে রাত ৯টা থেকে ফের শুরু হয় উড়োজাহাজ চলাচল। 

ফায়ার সার্ভিস ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গতকাল শনিবার বেলা সোয়া ২টার দিকে বিমানবন্দরটির আট নম্বর গেট-সংলগ্ন কার্গো হাউসে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। ওই অংশে দেশের বাইরে থেকে আমদানিকৃত পণ্য মজুদ রাখা হতো। বিমানবন্দরে আগুনের খবর পেয়ে প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট সেখানে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। একে একে ৩৬টি ইউনিট এতে যোগ দেয়। আগুন লাগার পরপরই দুর্ঘটনা এড়াতে হ্যাঙ্গারে থাকা কয়েকটি বিমান কিছুটা দূরে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। 

জানা গেছে, শাহজালাল বিমানবন্দরের পোস্ট অফিস ও হ্যাঙ্গারের মাঝামাঝি স্থানে কার্গো হাউস। আগুন লেগেছে আমদানির কার্গো কমপ্লেক্স ভবনে। এটির অবস্থান বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের পাশে। একে হ্যাঙ্গার গেট বলা হয়। 

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আগুনে ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। এ সময় ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বিমানবন্দরের কর্মীরাও আগুন নেভাতে তৎপর ছিলেন। কার্গো হাউসের বাইরে বিপুলসংখ্যক উৎসুক মানুষের ভিড় জমে যায়। বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকিং করে তাদের সরে যেতে বলা হয়। 

আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত এক ফায়ার ফাইটার গণমাধ্যমকে জানান, কার্গো হাউসের ওই অংশে থাকা কয়েকটি ড্রাম বিস্ফোরিত হতে দেখেছেন তিনি। আগুন নেভানোর সময় তীব্র ধোঁয়া ও প্রচণ্ড গরমে ফায়ার সার্ভিসের কয়েক সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে পাঠানো হয়। 

এয়ারপোর্ট কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠু বলেন, শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিনে কার্গো হাউসের নিয়মিত কাজকর্ম বন্ধ থাকে। তবে কুরিয়ার শাখায় আধাবেলা পর্যন্ত আনসারসহ লোকজন ছিল। কিন্তু আগুন লাগার পর আনসারসহ অন্যরা সবাইকে সরিয়ে দেন। তখন বলা হয়, গুদামে গোলাবারুদসহ কেমিক্যাল রয়েছে, যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। সবাই সরে যান।

মিঠু অভিযোগ করেন, আগুন নেভাতে এসে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ৮ নম্বর গেটে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অনুমতিজনিত জটিলতায় তারা ঢুকতে পারছিল না। বিমানের তিনজন কর্মী বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা জানিয়েছেন, কুরিয়ার শাখা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর তারা দৌড়ে বের হয়ে আসেন।

আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পক্ষ থেকে বলা হয়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে অগ্নিনির্বাপণে কাজ করছে বাংলাদেশ সিভিল অ্যাভিয়েশনসহ বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দুটি ফায়ার ইউনিট। এ ছাড়া শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীও।

বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা জানান, আগুনে পুড়েছে মূলত আমদানি করা পণ্য। বিদেশ থেকে পণ্যের চালান বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে তা খালাস হয় না। মালামাল কার্গো হাউসে রাখা হয়। সেখানেই শুল্ক বিভাগ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বিমান সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। বিমানবন্দর দিয়ে সাধারণত তুলনামূলকভাবে কম ওজনের মেশিনপত্র, তৈরি পোশাক, শাকসবজিসহ পচনশীল পণ্য, ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি করা হয়।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণে বিমানবন্দরের কার্গো হাউস এলাকায় কার্যক্রমে কিছুটা বিঘ্ন ঘটলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকা কাস্টমস হাউসের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নিয়েছে। 

১৫ আনসার সদস্য আহত

আগুন নেভাতে গিয়ে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ১৫ সদস্য আহত হয়েছেন। আনসার ও ভিডিপির গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. আশিকুজ্জামান গতকাল জানান, ঘটনাস্থলে আনসার ও ভিডিপির এক হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে আটজনকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়েছে। বাকি সাতজনকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

আগুন নেভাতে রোবট

আগুনের তীব্রতা বেশি থাকায় ফায়ার ফাইটারদের কাজ করতে সমস্যা হয়। কয়েকজন ফায়ার ফাইটার আহতও হন। এরপর আগুন নেভাতে ব্যবহার করা হয় ‘রিমোট কন্ট্রোল ফায়ারফাইটিং রোবট’। এ রোবট মানুষের সাহায্য ছাড়াই খুব কাছ থেকে আগুনে পানি নিক্ষেপ করে। 

তদন্তে দুই কমিটি

কার্গো হাউসে আগুনের ঘটনায় সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। ফ্লাইট সেফটির প্রধানকে সভাপতি করে এটি গঠন করা হয়। কমিটি অগ্নিকাণ্ডের কারণ চিহ্নিত এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করবে। সেই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের দায় চিহ্নিত করবে। ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে সুপারিশমালাও তৈরি করবে এ কমিটি। কমিটিকে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া সরকারের তরফে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের জন্য।

তারেক রহমানের উদ্বেগ

কার্গো হাউসে অগ্নিকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে এক ফেসবুকে পোস্টে তিনি উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তেরও আহ্বান জানান। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে বিবৃতি দিয়েছেন।