জুলাই সনদ আমাদের নতুন পথ দেখায়: প্রেস সচিব
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, জুলাই সনদ নতুন পথ দেখায়, বারবার আলোচনার টেবিলে ফিরে যেতে।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে এ কথা লেখেন শফিকুল আলম। নিচে তার পোস্টটি তুলে ধরা হলো:বহু বিপ্লবই ইতিহাসের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় যখন রাস্তায় অর্জিত পরিবর্তনগুলো আইনে রূপ নিতে পারে না। তাই অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন—সড়ক আন্দোলন, প্রাণঘাতী প্রতিবাদ, ঘেরাও, হরতাল কিংবা অবরোধই বিপ্লবের সহজ অংশ। প্রকৃত জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরীক্ষা শুরু হয় তখনই, যখন মানুষ যে আদর্শ ও উদ্দেশ্যে রক্ত ঝরিয়েছে, তা আইনে রূপ দেওয়ার সময় আসে।
বাংলাদেশ এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু সেই নয় মাসের সংগ্রাম এবং পাকিস্তানি শাসনামলের দীর্ঘ বঞ্চনা—যে আদর্শ ও স্বপ্নের আগুনে জ্বলছিল, সংবিধান রচনার কুয়াশায় তা অনেকটাই হারিয়ে যায়।
১৯৭১-এর ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন রাষ্ট্র গঠনের তাড়নায় আমরা ভুলে গিয়েছিলাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি—আমরা কেমন দেশ গড়তে চাই, আমাদের জাতীয় পরিচয় কী হবে? সেই সময়ের নেতারা, ট্র্যাজেডির ভারে ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত, প্রয়োজনীয় দূরদৃষ্টি প্রদর্শন করতে পারেননি। এর ফল আজও আমাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
বাংলাদেশের সংবিধান আমাদের বারবার ব্যর্থ করেছে। আমরা একের পর এক মূল ধারা বিকৃত করেছি, তাড়াহুড়ো করে আইন যোগ-বিয়োগ করে তা সাময়িকভাবে টিকিয়ে রেখেছি। কিছুদিনের জন্য মনে হয়েছিল—এই ভাঙাচোরা কাঠামো হয়তো চলবে। কিন্তু না, যখন সেই শক্তিমানরা পতিত হলেন, গোটা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল। জনগণের ক্ষোভে ভেসে গেলো বহু সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া রাজনৈতিক দলও, কারণ ভিত্তিটাই ছিল দুর্বল।
আইন প্রণয়ন ও সংবিধান সংস্কারের কাজ কেবল ক্ষমতার খেলা নয়—এটা সেই নেতাদের কাজ, যারা সময়ের সীমা পেরিয়ে ভবিষ্যৎকে দেখতে পারেন, যারা জানেন আইনের প্রতিটি শব্দের গুরুত্ব কত গভীর। দুই দশকেরও বেশি আগে, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে আমরা একযোগে কঠোর আইন পাস করেছিলাম। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, সেই আইনের অপ্রত্যাশিত পরিণতিতে হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক গ্রামেই এখন প্রায় সব মামলাই এই আইনের অধীনে দায়ের হয়, যার সঙ্গে মূল উদ্দেশ্যের সামান্যও সম্পর্ক নেই।
এবারের ‘জুলাই চার্টার’ সেই রাজনৈতিক পরিপক্বতার এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এটি আমাদের শিখিয়েছে—শব্দেরও সীমা আছে, কেবল রাস্তায় স্লোগান নয়, আইনের ভাষাই সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকতে হবে। যেমনভাবে আমেরিকার পূর্ববর্তী নেতারা প্রায় আড়াই শতাব্দী আগে তাদের সংবিধান ও অধিকার সনদ নিয়ে গভীর বিতর্ক করেছিলেন।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
জুলাই চার্টারের বৈপ্লবিক দিকটি এখানে রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান দাবি করছে না। বরং এটি দীর্ঘ আলোচনা, মতবিনিময় ও ঐকমত্যের ফসল। ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকার যখন এটি বাস্তবায়নে এগোবে, তখনো হয়তো এটি প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হতে পারে। তবু এটি ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে—যে অধ্যায়ে আমরা গর্বভরে বলতে পারবো, একসময় আমাদের নেতারা একসঙ্গে বসেছিলেন, আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছিলেন জাতির দীর্ঘদিনের সংকট সমাধানের।
তাদের পূর্ণ সফলতা না এলেও এটি ব্যর্থতা নয়। বরং জুলাই চার্টারের শক্তি এখানেই—এটি আমাদের নতুন পথ দেখায়, আমাদের আহ্বান জানায় বারবার আলোচনার টেবিলে ফিরে যেতে, পরস্পরের মত শুনতে, সহযোগিতার মনোভাব বজায় রাখতে—যতক্ষণ না আমরা নিশ্চিত হচ্ছি, এবার আমাদের তৈরি করা শব্দগুলো আর আমাদের ব্যর্থ করবে না।
আমাদের সময়/জেএইচ