প্রাণ ঝরলেও রহস্যজনক কারণে সরে না গুদাম

২৮ ঘণ্টা পর রাসায়নিক গুদামের গ্যাস নিয়ন্ত্রণে ।। তদন্ত কমিটি গঠন, আর্থিক সহায়তা ঘোষণা ।। এটি কাঠামোগত ও গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড : আইপিডি ।। প্রশাসন ম্যানেজ করে চলে রাসায়নিক গুদাম

ইউসুফ সোহেল
১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২৮
শেয়ার :
প্রাণ ঝরলেও রহস্যজনক কারণে সরে না গুদাম

রাজধানীর রূপনগরের শিয়ালবাড়ীতে অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জনের প্রাণহানির ঘটনায় তদন্ত ও দায় নির্ধারণ নিয়ে তৎপর হয়েছে সরকার। শ্রম মন্ত্রণালয় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, গুদামে থাকা দাহ্য রাসায়নিকের কারণে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগেছে প্রায় ২৮ ঘণ্টা। নগর পরিকল্পনাবিদ, শ্রম সংগঠন ও পরিবেশবিদরা বলছেন, প্রশাসনের গাফিলতি ও অনুমোদনহীন গুদাম পরিচালনার সুযোগই এই দুর্ঘটনার মূল কারণ। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, বারবার অভিযোগের পরও পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

রাজধানীতে কেমিক্যাল (রাসায়নিক) গোডাউন স্থাপন, পরিচালনা ও তদারকির ক্ষেত্রে জড়িত একাধিক সরকারি সংস্থা। রাজউক, সিটি করপোরেশন, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ওষুধ প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরের অনুমতি এবং ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কেমিক্যাল মজুদের আগে নিয়মিত পরিদর্শন ও নবায়ন করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। বিশেষ নজরদারি রয়েছে আইনশৃঙ্খালা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদেরও। কিন্তু এত নজরদারির ফাঁক গলিয়ে বছরের পর বছর ধরে মিরপুরের রূপনগরের শিয়ালবাড়ী এলাকার ৩ নম্বর সড়কে জনৈক শাহ আলম দিব্যি চালিয়ে আসছিলেন অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন।

গত মঙ্গলবার এই টিনশেডের কেমিক্যাল গোডাউন ও পার্শ্ববর্তী গার্মেন্টস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ১৬ জন। কেমিক্যালের বিষাক্ত গ্যাসে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অগ্নিকাণ্ডস্থলের আশপাশের বাসিন্দারাও।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এই গোডাউনসহ মিরপুরের কয়েকটি অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউনের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবৈধ গোডাউনগুলোও দিব্যি চলছে। রূপনগরে প্রাণহানির ঘটনাকে কাঠামোগত ও গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড বলে বিবেচনায় নিয়ে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টও (আইপিডি)। গতকাল বুধবার আইপিডির পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ও নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানান।

মিরপুরের শিয়ালবাড়ীর ঘটনাই নয়, এর আগে রাজধানীর পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা এবং নিমতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা কেমিক্যালের গোডাউনের আগুনে ঝরে গেছে ২ শতাধিক প্রাণ। প্রতিটি ঘটনার পর এলাকাগুলো নিরাপদ নয় বলে সতর্ক করেন বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা। ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয় ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সতর্ক হয়নি কেউ-ই।

জনবহুল এলাকা বা আবাসিক ভবনে কেমিক্যাল গোডাউন স্থাপন আইনত নিষিদ্ধ হলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরান ঢাকা, মিরপুর, রূপনগর, পল্লবী ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতেও এখন অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে যত্রতত্রে রাখা রয়েছে বিভিন্ন রাসায়নিক সামগ্রী। বিপজ্জনকভাবে রাখা এসব গোডাউনের কেমিক্যাল থেকে যেকোনো সময়ে বড় ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার রাসায়নিক পণ্যের গুদাম রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে বাসাবাড়িতে। তা ছাড়া রাজধানীজুড়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থা ৪ হাজার ৮৫০টিরও বেশি গোডাউনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যার মধ্যে মিরপুর ও উত্তরা রয়েছে। পুরান ঢাকাসহ রাজধানীতে প্রায় ৪ হাজার ব্যবসায়ী রাসায়নিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

জানা গেছে, পুরান ঢাকায় মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকিগুলো অবৈধ। বিগত সরকারের সময় বলা হয়েছিল, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরান ঢাকা থেকে দাহ্য রাসায়নিকের ব্যবসা স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরেনি।

গতকাল পুরান ঢাকা ও মিরপুরের বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আবাসিক ভবনগুলোর নিচতলায় বেশির ভাগই রয়েছে কারখানা ও গোডাউন। এসব গোডাউনেই মজুদ রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইল ইত্যাদি। আগুনের সংস্পর্শে এলে ভয়ংকর হয়ে ওঠে এসব রাসায়নিক পদার্থ। আর কেমিক্যালের দোকানগুলোতে সারি সারি প্লাস্টিকের ড্রাম আর দাহ্য রাসায়নিক পদার্থে ঠাসা। কোনো কোনোটিতে আবার বস্তাভর্তি দাহ্য কেমিক্যাল। তার ঠিক ওপরেই এলোমেলোভাবে ঝুলছে অসংখ্য বৈদ্যুতিক তার। আরমানিটোলা, লালবাগ, কোতোয়ালি, বংশাল, চকবাজারসহ কয়েকটি এলাকায় কেমিক্যাল দোকানগুলোতে এমন চিত্র নজরে এসেছে।

অভিন্ন চিত্র রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরের। এই থানা এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কেমিক্যাল গোডাউন। মিরপুর ১২ নম্বরের আলুব্দি ঈদগাহ মাঠ এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি কেমিক্যাল গোডাউন। এর মধ্যে টিপু কেমিক্যাল, তানিশা ট্রেডার্স অ্যান্ড কেমিক্যাল, এভারগ্রিন কেমিক্যাল ও এমএস আলম ট্রেডিং। রূপনগর শিল্প এলাকার কে-ব্লকের ২ নম্বর রোডের শাহ্ আলী ট্রেডিংয়ে সাাজানো কেমিক্যালের সারি সারি ড্রাম। এসব গোডাউন থেকে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ওয়াশিং কারখানার জন্য কেমিক্যাল নেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সরকারি অনুমোদন ছাড়াই চলছে এসব গোডাউন।

রূপনগরের স্থানীয় বাসিন্দা ইমন রহমান বলেন, গত মঙ্গলবার শিয়ালবাড়ীর ৩ নম্বর সড়কে যে টিনশেডের রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগে সেটির মালিক শাহ আলম ওরফে কেমিক্যাল শাহ আলমের। ভবন ও গুদাম কোনোটিরই ফায়ার সেফটি প্ল্যান বা লাইসেন্স ছিল না। এই এলাকায় আরও ১০ থেকে ১২টি কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। শাহ আলমেরই রয়েছে ৩টি গোডাউন। দুর্ঘটনার আগে কদিন পর পর ওই গোডাউনে ফায়ার সার্ভিসের লোক এলেও রহস্যজনক কারণে কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

গতকাল বুধবার দুপুরে শিয়ালবাড়ীর ঘটনাস্থলে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান জানান, অগ্নিকাণ্ডের পর একদিন পার হলেও কেমিক্যাল গুদামের আগুন এখনও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ঘটনাস্থল থেকে এখনও ঘন ধোঁয়া উড়ছে এবং বাতাসে মিশে গেছে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর টক্সিক ও ক্লোরিন গ্যাস। রাসায়নিক থেকে তৈরি ধোঁয়া ও গ্যাস ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।

এর আগে কেমিক্যালের গুদাম থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ার উৎপত্তিস্থল অনুসন্ধান করতে বুধবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটে বিশেষ সুরক্ষা পোশাক (কেমিক্যাল ফায়ার স্যুট) পরে গোডাউনটির ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন ফায়ার সার্ভিসের চারজন সদস্য। কিন্তু ভেতরে প্রচুর সাদা ধোঁয়া থাকায় তারা ঢুকতে পারেননি।

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান বলেন, আমাদের বিশেষজ্ঞ দল কেমিক্যাল স্যুট পরে গুদামের প্রধান ফটক খুলতে সক্ষম হলেও ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। ভেতরে প্রচুর সাদা ধোঁয়া রয়েছে, যা অত্যন্ত বিষাক্ত। ফলে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও সময় লাগবে। দীর্ঘ সময় লাগবে কেমিক্যাল পুরোপুরি অপসারণ করতেও।

বুধবার বিকালে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম জানায়, ফায়ার সার্ভিসের সর্বশেষ ৫টি ইউনিট রূপনগরে কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন প্রায় ২৮ ঘণ্টা পর অর্থাৎ গতকাল বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কেমিক্যাল গোডাউনের মালিকের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ হয়নি। তিনি এখনও ফায়ার সার্ভিস বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।

এদিকে শিয়ালবাড়ী এলাকায় অবস্থিত শাহ আলম কেমিক্যাল গোডাউন এবং এর পাশের একটি পোশাক প্রিন্টিং কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় সাত সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শ্রম মন্ত্রণালয়। গতকাল দুর্ঘটনাকবলিত গোডাউনের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, জনবহুল এলাকায় যেন কেমিক্যাল গোডাউন না হয়, সে বিষয়ে শক্ত পলিসি থাকতে হবে। এ ধরনের কেমিক্যাল যেখানে রাখা হয়, এগুলো হচ্ছে বেআইনি জায়গা। আমি মনে করি, প্রথম যে জিনিসটি করতে হবে, সরকারকে ইমিডিয়েট ইনভেস্টিগেশন করতে হবে। যারা এটা করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

রূপনগরে আবাসিক এলাকায় অবৈধ ওই কেমিক্যাল গুদামে বিস্ফোরণে ১৬ শ্রমিক নিহত ও বহু আহত হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) গতকাল বলেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে কেমিক্যাল বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়লেও এসব ঘটনার উপযুক্ত বিচার বা দায়ীদের শাস্তির নজির এখনও গড়ে ওঠেনি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি অসহায় শ্রমজীবী মানুষের জীবনকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করছে। এসব ঘটনার মূল কারণ দায়িত্বহীনতা, অবহেলা এবং অসাধু মালিকদের মুনাফালোভী মানসিকতা।