বদলি-পদোন্নতি নিয়ে জনপ্রশাসনে অস্থিরতা

তাওহীদুল ইসলাম
১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:০০
শেয়ার :
বদলি-পদোন্নতি নিয়ে জনপ্রশাসনে অস্থিরতা

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি আর পদোন্নতিতে চলছে নাটকীয় উত্থান-পতন। একদিন প্রজ্ঞাপন জারি হচ্ছে, পরদিনই তা প্রত্যাহার। কোথাও নতুন মুখ, কোথাও পুরনোদের প্রত্যাবর্তন। মাঠ প্রশাসন থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত অস্থিরতা ছড়িয়েছে। ভালো পদায়নের আশায় কর্মকর্তাদের মধ্যে দলীয় ট্যাগ দেওয়া-নেওয়ার প্রতিযোগিতাও থামছে না। ভালো পদায়নের আশায় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও ধর্ণা দিচ্ছেন কর্মকর্তারা।

গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এপিডি অনুবিভাগের দায়িত্ব নিয়েছেন অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ সরকার। তার আগে গত রবিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সচিবের দায়িত্ব নেন এহছানুল হক। তাদের প্রচেষ্টায় জনপ্রশাসনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার আশা প্রকাশ করছেন প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১৪ অক্টোবর দুজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) প্রেষণে বদলির আদেশ দিয়ে পরদিনই তা প্রত্যাহার করা হয়। গতকাল ফেনীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) সাইফুল ইসলামকে করা হয়েছে চট্টগ্রামের ডিসি আর বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ সোলায়মান হয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডিসি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব আফছানা বিলকিসকে করা হয়েছে মাদারীপুরের ডিসি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব মনিরা হক হয়েছেন ফেনীর ডিসি।

তবে এর আগেই ২১ সেপ্টেম্বরের প্রজ্ঞাপনে মনিরা হককে নওগাঁর ডিসি করা হয়েছিলÑ এখন সেটি বাতিল। চট্টগ্রামের ডিসি নিয়োগ নিয়েও দেখা গেছে একের পর এক প্রজ্ঞাপন ও প্রত্যাহারের দোলাচল। গত ২১ সেপ্টেম্বর নওগাঁর ডিসি আব্দুল আউয়ালকে চট্টগ্রামের ডিসি হিসেবে জারি করা

প্রজ্ঞাপনটি গতকাল বাতিল করা হয়েছে। ২৩ দিন পর দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জেলা সদর চট্টগ্রামে ডিসি নিয়োগে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করল সরকার। এর আগে পুরনো ডিসি প্রত্যাহারের দিনই নতুন ডিসির প্রজ্ঞাপন হয়েছে। তারপর এতদিন কেটে গেলেও নতুন ডিসি চট্টগ্রামে যোগ দেননি। এতদিন পর আগের প্রজ্ঞাপন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগের দুটি জেলার ডিসি কর্মস্থলে যোগদানের পরপরই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে শুরু করে। এক বছর পর তাদের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কক্সবাজারের ডিসি নিয়োগ হওয়ার পরও প্রায় একই চিত্র। উচ্চ মহলে দ্বন্দ্বের কারণে প্রথমে তাকে স্টেশনে যেতে নিষেধ করা হয়। ৮ দিন পর আবার তাকেই পাঠানো হয়। ২০ জন ডিসি যুগ্ম সচিব পদোন্নতি পাওয়ার ৭ মাস পরও মাঠে কাজ করছেন।

জনপ্রশাসনে পদোন্নতি নিয়েও চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। ৭ মাস আগে ২১ জন জেলা প্রশাসক যুগ্ম সচিব পদে উন্নীত হলেও ২০ জন এখনও আগের দায়িত্বে রয়েছেন। নতুন করে উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন শাহ নুসরাত জাহান, যিনি ২৮ আগস্ট থেকে ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা পেলেও আর্থিক সুবিধা পাবেন না। একইভাবে আরিফা সিদ্দিকা ও মেহেদী হাসানকেও একই তারিখ থেকে জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়েছে। আর ২৮ আগস্টের পৃথক প্রজ্ঞাপনে ২৬৯ জনকে উপসচিব করা হয়।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে প্রশাসনে এখনও দলীয় ট্যাগ দেওয়ার প্রবণতা কাটেনি। কেউ নিজেকে পুরনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার ‘যোগ্য প্রমাণ’ হিসেবে তুলে ধরছেন, কেউ আবার প্রতিপক্ষকে ভিন্ন দলের মানুষ বলে বদনাম করছেন। ফলে প্রশাসনের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও অবিশ্বাস বাড়ছে। অনেকে আবার পদোন্নতি বা কাক্সিক্ষত বদলির আশায় পলিটিক্যাল লিংক (রাজনৈতিক সংযোগ) খুঁজছেন।

গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে দেখা গেছে, অতীত সরকারের সময়ে সুবিধাভোগী কিছু কর্মকর্তা এখন অন্য দলের পরিচয়ে নিজেদের উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন। অথচ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় দেওয়া নিয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২১ ব্যাচের এক কর্মকর্তার বিএনপির পরিচয় সামনে এলে সেসময়ে তার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সার্টিফিকেট দেন ওই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের বলে। অথচ পারিবারিকভাবে তিনি বিএনপির আদর্শের অনুসারী। পরিচয় গোপন করে গেল সরকারের আমলে তিনি সুবিধা নিয়েছেন। এখন একই ব্যক্তি নিজেকে বিএনপির পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

প্রশাসনে দলীয় প্রভাব নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত। নির্বাচনের আগে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়েও সন্দেহ ঘনাচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো আসলে নিজেদের ঘনিষ্ঠ মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসাতে চাইছে। এ নিয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিঞার মন্তব্য হচ্ছেÑ জনপ্রশাসন এখন সাংঘাতিক দুর্বল অবস্থায় আছে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রশাসন সঠিকভাবে না চললে তা দেশের জন্য অনেক ক্ষতি। যোগ্য, অভিজ্ঞ, দক্ষ, কৌশলী ও সাহসী কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনে নিয়োগ দিতে হবে। কোনো তদবিরের মাধ্যমে মাঠ প্রশাসন সাজানো হলে সেখানে ভালো কিছু আশা করা যায় না। নির্বাচন সামনে রেখে সৎ ও দক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে সাজাতে হবে প্রশাসন।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ বিগত বছরগুলোয় জনপ্রশাসনে দলীয় লোকদের নিয়োগ ও দলীয় কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদান, সব আইনানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং আইনানুগ সিদ্ধান্তের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত প্রদান প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। বিভিন্ন সময়ে সরকার তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ব্যবহার করেছে; এমনকি জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ করে এর পেশাদারি চরিত্র নষ্ট করেছে।