নোট অব ডিসেন্টসহ জুলাই সনদ চূড়ান্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২৮
শেয়ার :
নোট অব ডিসেন্টসহ জুলাই সনদ চূড়ান্ত

সমঝোতা না হওয়ায় নোট অব ডিসেন্টসহ ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সনদে বাস্তবায়ন পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। গতকাল মঙ্গলবার রাতে চূড়ান্ত অনুলিপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। আগামী ১৭ অক্টোবর শুক্রবার জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ সনদে স্বাক্ষর হবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ বিষয়ে জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের চূড়ান্ত ভাষ্য পাঠানো হয়েছে। এতে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত নেই। দলগুলো যে বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, তার ভিত্তিতেই তারা স্বাক্ষর করবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শমতো ছোটখাটো কিছু পরিবর্তন ও ভুল সংশোধন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল, এটি আগে স্বাক্ষর করা উচিত। আর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আমরা সরকারকে সুপারিশ জানাব এবং আগামীতে সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে বলে জানান তিনি।

কমিশনসূত্রে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের (সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন) সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে ৩৩টি এবং দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে দুই পর্বের

আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’। তিন ভাগের এই সনদের প্রথম ভাগে পটভূমি, দ্বিতীয় ভাগে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব এবং তৃতীয় ভাগে সনদ বাস্তবায়নের ৭ দফা অঙ্গীকারনামা রয়েছে।

সনদ পর্যালোচনায় দেখে গেছে, সনদের দ্বিতীয় ভাগে উল্লিখিত সংস্কার প্রস্তাবে উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রী দলের প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না, এমন বেশ কয়েকটি প্রস্তাবে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের আপত্তি থাকায় তারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। সেসব নোট অব ডিসেন্টসহ জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করা হয়েছে।

জানা গেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত অনুযায়ী গণভোটের সুপারিশ থাকবে। দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় পর্বের সংলাপ ও বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ শেষে গণভোটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদিও গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নির্ধারণে দায়িত্ব সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে সংবিধানসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ইস্যুতে পৃথক সুপারিশও থাকবে। সুপারিশ সংবলিত এ জুলাই সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর করবেন ৩০টি রাজনৈতিক দলের ৬০ জন প্রতিনিধি। এ ছাড়া জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ কমিশনের সদস্যরাও স্বাক্ষর করবেন ওই সনদে।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দার জানান, জুলাই সনদে স্বাক্ষরের জন্য ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের পক্ষ থেকে কমিশনের কাছে তাদের স্বাক্ষরকারী প্রতিনিধিদের নাম নিশ্চিত করেছে। জুলাই সনদের একটি ‘মাস্টারপিস’ থাকবে, যার তিনটি অংশ থাকবেÑ সংস্কার উদ্যোগের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটসহ ভূমিকা, সংস্কার প্রস্তাবের তালিকা ও একটি অঙ্গীকারনামা। এদিকে অঙ্গীকারনামার ৩০টি কপি দলীয় প্রতিনিধিদের স্বাক্ষরের জন্য উপস্থাপন করা হবে। পরে প্রতিনিধিরা ওই ‘মাস্টারপিস’-এ স্বাক্ষর করবেন বলে জানান তিনি।

এদিকে কয়েকটি দল জানিয়েছে, সনদ পর্যালোচনা করে তারা স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নেবেন।

কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে। ইতোমধ্যে অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এ আয়োজনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে সহায়তা করছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রায় তিন হাজার অতিথিকে এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বিভিন্ন গণ-অভ্যুত্থানের ওপর বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন থাকবে। অনুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। সংসদের দক্ষিণ প্লাজার সিঁড়ির মাঝামাঝিতে তৈরি হবে স্বাক্ষর মঞ্চ। মঞ্চ তৈরির পাশাপাশি জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় সাজসজ্জার কাজও চলছে।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী জানান, জুলাই সনদ বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হতে যাচ্ছে। এটি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সামাজিক সংস্কৃতিতেও প্রভাব ফেলবে। এ কারণে অনুষ্ঠানটিকে প্রত্যেকের জীবনে স্মরণীয় করে রাখার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে এখনও অনুষ্ঠানসূচি চূড়ান্ত হয়নি। তিনি আরও জানান, অনুষ্ঠানে প্রজেকশন থাকবে, সেখানে আমাদের দীর্ঘ যাত্রা কীভাবে হয়েছে, সেটির পুরাটা দেখা যাবে। জুলাইয়ের পটভূমিটা তুলে ধরা হবে। অনুষ্ঠানে অভ্যুত্থানের অনুভূতির আবহ তৈরি করা হবে। এ ছাড়া ৫ আগস্ট একটা সরকারবিহীন অবস্থা, এর পরে দীর্ঘদিন পুলিশবিহীন অবস্থা ও প্রশাসন ভেঙে পড়া অবস্থা থেকে পুরো বাংলাদেশের মানুষ যখন সবাই এক হয়ে দেশটা প্রটেক্ট করছে, নিজের এলাকা পাহারা দিয়েছে, সেটি দেখানো হবে।

এদিকে সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে দলগুলো গণভোটে একমত হলেও ভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। এ বিষয়ে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।