ল্যান্ডিং সিস্টেম অকেজো, ঝুঁকিতে বিমান চলাচল

গোলাম সাত্তার রনি
১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩৮
শেয়ার :
ল্যান্ডিং সিস্টেম অকেজো, ঝুঁকিতে বিমান চলাচল

সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আধুনিক ইনস্ট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম (আইএলএস) দীর্ঘদিন অকেজো থাকায় খারাপ আবহাওয়ায় বিমানের নিরাপদ অবতরণে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। দৃশ্যমানতা কমে গেলে ফ্লাইট ডাইভার্ট করায় বিলম্ব ও জ্বালানি খরচ বাড়ছে; ফলে যাত্রীদের ভোগান্তি ও ফ্লাইট পরিচালন ব্যয় উভয়ই বেড়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) নতুন আইএলএস স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও এখনও কার্যকর হয়নি। দেশের দ্বিতীয় ব্যস্ততম এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিদিনের ফ্লাইট পরিচালনা অনেকটাই নির্ভর করছে আবহাওয়া ও পাইলটদের দক্ষতার ওপর।

আইএলএস হলো এমন এক নেভিগেশন ব্যবস্থা যা বিমানকে রানওয়েতে সুনির্দিষ্টভাবে অবতরণে সহায়তা করে, বিশেষত কুয়াশা, বৃষ্টি বা দৃশ্যমানতা কম থাকলে। তবে ওসমানী বিমানবন্দরের আইএলএস ২০২৩ সাল থেকেই ত্রুটিপূর্ণ।

বেবিচকের একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে করা ফ্লাইট ক্যালিব্রেশন পরীক্ষায় ‘জিপি ওয়াইড অ্যালার্ম, আরডিএইচ এবং এলএলজেড ব্যারো অ্যালার্ম’ আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান সংস্থার (আইসিএও) নির্ধারিত মানের বাইরে পাওয়া যায়। এতে আইএলএস সিস্টেমকে ‘অসন্তোষজনক’ উল্লেখ করা হয়।

২০২৫ সালের মার্চ মাসে ফ্লাইট ইন্সপেকশন ইউনিট (এফআইইউ) ফের পরীক্ষা চালিয়েও একই ফল পায়। এরপর বেবিচক বিদ্যমান আইএলএস সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে। বেবিচকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরনো যন্ত্রাংশের সীমাবদ্ধতা, অ্যান্টেনা রিফ্লেকশন ও পারিপার্শ্বিক অবকাঠামোর কারণে সিগন্যাল বিকৃতি ঘটছে, এতে নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।

বিমানবন্দর সূত্র জানায়, আইএলএস কার্যকর না থাকায় বর্ষাকাল বা কুয়াশার সময় বিমানের অবতরণে বিলম্ব হচ্ছে। অনেক ফ্লাইট ঢাকায় ডাইভার্ট করতে হয়, আবার কখনো যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় আকাশ পরিষ্কার হওয়ার জন্য। জ্বালানি খরচও বেড়ে যায়।

স্থানীয় বিমান কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেটে মেঘ বা বৃষ্টি হলেই বিমান অবতরণে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আইএলএস থাকলে এই ঝুঁকি অনেকটাই কমে যেত।

২০২৪ সালে শীত মৌসুমে দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় একাধিক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বিকল্পভাবে ঢাকায় নামানো হয়েছিল। এ ধরনের পরিস্থিতি যাত্রীদের ভোগান্তির পাশাপাশি ফ্লাইট অপারেটরদেরও আর্থিক ক্ষতি বাড়াচ্ছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ২০২৫ সালের জুলাই মাসে বেবিচক চার সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্যরা সরেজমিন তদন্ত করে আন্তর্জাতিক মান অনুসারে নতুন আইএলএস স্থাপনের কারিগরি প্রস্তাবনা, নকশা ও পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করে। গত ২০ আগস্ট বেবিচকের চেয়ারম্যানের দপ্তরে প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন সিস্টেম চালু হলে বিমান অবতরণ আরও নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ হবে, বিশেষত খারাপ আবহাওয়ার সময়। বর্তমান লোকালাইজার অ্যান্টেনা অ্যারো রানওয়ে ২৯ থ্রেশহোল্ড থেকে প্রায় ৩৩৬ মিটার দূরে অবস্থিত, এতে ২০টি অ্যান্টেনা উপাদান রয়েছে। অ্যান্টেনার পেছনে সীমানা প্রাচীর ও আলোক মাস্ট থাকার কারণে সিগন্যাল রিফ্লেকশন ঘটে, যা সিস্টেমের কার্যকারিতা হ্রাস করে। গ্লাইড পাথ মাস্ট রানওয়ে ১১ থ্রেশহোল্ড

থেকে ৩০০ মিটার অফসেটে রয়েছে, কিন্তু উচ্চতা ও কৌণিক সীমা আইসিএও মানদণ্ডের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ কারণেই প্রতিবার ফ্লাইট ক্যালিব্রেশনে সিগন্যাল বিকৃতি ধরা পড়ছে।

প্রতিবেদনে নতুন আইএলএস স্থাপনের পর রানওয়ে ২৯ এলাকায় সিম্পল অ্যাপ্রোচ লাইটিং সিস্টেম পুনঃস্থাপন এবং উন্নত গ্লাইড পাথ সিগন্যাল সংযোজনের সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি বেবিচকের আইএলএস ক্রিটিক্যাল ও সেনসিটিভ এরিয়া ম্যানেজমেন্ট ম্যানুয়াল প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। নতুন আইএলএস স্থাপনের সময় রেফারেন্স ডাটুম হাইটের মান ১৫ মিটারের মধ্যে রাখার কথাও বলা হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণের আগে সিগন্যাল বিকৃতি বা মাল্টিপাথ ইন্টারফেরেন্স কমাতে গণনাভিত্তিক সিমুলেশন করতেও সুপারিশ করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বব্যাপী বিমান নেভিগেশন সিস্টেমে সাইবার হামলার ঝুঁকি বেড়েছে। এজন্য নতুন আইএলএস প্রকল্পে জাতীয় সাইবার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিমকে যুক্ত করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাতে কোনো অননুমোদিত প্রবেশ বা সিগন্যাল টেম্পারিং ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেটের ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়ার ধরন এমন যে, আইএলএস ছাড়া নির্ভরযোগ্য অবতরণ প্রায় অসম্ভব। নতুন সিস্টেম চালু হলে কুয়াশা ও বৃষ্টির মধ্যেও বিমান নিরাপদে নামতে পারবে। তারা আরও বলছেন, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নতুন আইএলএস স্থাপন বাংলাদেশের বিমান চলাচল খাতে এক বড় পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে। এটি কার্যকর হলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আকাশপথে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা আরও নির্ভরযোগ্য হবে এবং নিরাপত্তা মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হবে।

বেবিচকের সদস্য অপারেশন এয়ার কমোডর আবু সাঈদ মেহবুব খান আমাদের সময়কে বলেন, নতুন আইএলএস স্থাপনের উদ্যোগ আছে। আরও কিছু কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে একটা কমিটি করে দেওয়া হয়েছিল। ওখানে আইএলএস বসানো যাবে কিনা, কোথায় বসাতে হবে, বসালে কী কী কাজ করতে হবেÑ এসব নিয়ে সপ্তাহ খানেক হলো কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এখন নতুন আইএলএস বসানোর প্রকিউরমেন্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এ বছরের এপিবিতেও এটা রাখা হয়েছে। নতুন আইএলএস স্থাপনের জন্য সিএএবি আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।