রাত হলেই নামে গুজব

লক্ষ্য- রাজনৈতিক বিভেদ ও আতঙ্ক তৈরির পাশাপাশি ভিউ বাড়ানো ।। চুরি-ডাকাতি থেকে শুরু করে সরকার পতন ও সেনা বিদ্রোহের গুজব ।। মোকাবিলায় নেই সরকারের দক্ষ কর্মী ও সঠিক তথ্যের প্রচার

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩১
শেয়ার :
রাত হলেই নামে গুজব

সন্ধ্যা নামতেই দেশজুড়ে শুরু হয় গুজবের স্রোত। চুরি-ডাকাতি থেকে শুরু করে সরকার পতন আর সেনা বিদ্রোহের মতো নানান গুঞ্জন শুরু হয়। কোথাও বলা হয় ‘সরকার আজ রাতেই পড়ে যাচ্ছে’; আবার কোথাও দাবি করা হয়, ‘সেনাবাহিনী বিদ্রোহে নামছে।’ দেশ ও দেশের বাইরে থেকে প্রচার করা এসব তথ্যে জনগণ বিভ্রান্ত, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যদিও শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ ঘটনাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ভিউ বাড়ানোর গল্প বলে প্রতীয়মান হয়।

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১ হাজার ৭৯৫টি ভুল তথ্য বা গুজব ছড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ৭৪টি, পুলিশকে নিয়ে ৩০টি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক তথ্য সরবরাহের অভাবে এমন গুজব প্রতিদিন ডালপালা মেলছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে এসব গুজব ঠেকানোও একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত কয়েক মাসে গুজব ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা এবং সামাজিক মাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে গুজব এখন সন্ত্রাসে পরিণত হয়েছে। অনেক মানুষ ভুয়া খবরের কারণে সামাজিকভাবে হেনস্তা, এমনকি সহিংসতার শিকারও হয়েছেন। গুজব প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি হতে পারে।

গত শনিবার দিবাগত মধ্যরাতে সামাজিক মাধ্যমে তথ্য প্রচার করা হয়- সেনাবাহিনীর ৪৬ ব্রিগেডের কিছু অস্বাভাবিক মুভমেন্ট দেখা যাচ্ছে। যে কোনো সময় ক্যু হতে পারে। ছাত্র-জনতাকে রাজপথ দখলে নেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়। ক্যু এর সেই গুজব অনেকেই সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্নভাবে শেয়ার করে। মুহূর্তে তা ভাইরাল হয়ে যায়। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে জানানো হয়, ডিপ্লোমেটিক জোনের চারটি এপিসি প্রতি মাসে রোটেট করা হয়। রাতে সেই এপিসির সঙ্গে আটটি প্যাট্রোল একসঙ্গে মুভ করেছে।

ঢাকার ফার্মগেটের লিয়াকত হোসেন বলেন, মধ্যরাতে মাত্রই ঘুমিয়েছিলাম। রাত ৩টার দিকে ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙে। এক আত্মীয় ফোনের অপর প্রান্ত থেকে জানান, সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। তার ফোন রাখতেই ইস্কাটন এলাকায় বসবাস করা এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিক থেকে গুলি আর কামানের গোলার শব্দ হচ্ছে। এরপর ফেসবুকে ঢুকেই দেখি ‘ক্যু হতে পারে’- এমন স্ট্যাটাস ভাইরাল। ভীষণ অস্থিরতা আর আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পরিচিত কয়েকজনকে ফোন দিলাম। পরে নিশ্চিত হলাম যে, বাংলামোটর এলাকায় কোনো একটি নির্বাচনে বিজয়ী দল পটকা ফুটিয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) প্রসিকিউটর ও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা গতকাল আমাদের সময়কে বলেনÑ গুজব যেভাবে বাড়ছে, সেটা প্রতিরোধে সরকারের ব্যবস্থাপনা সেভাবে কার্যকর নয়। আগামী নির্বাচনে গুজবের সংখ্যা আরও বাড়বে। তাই ওই সময় গুজব ঠেকানোই হবে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, দায়িত্বশীল মানুষও গুজব ছড়াচ্ছে এবং গুজবের তথ্য শেয়ার করছে। পৃথিবীর উন্নত দেশেও গুজব তৈরি হয়। তবে তারা দ্রুত সঠিক তথ্যটি ছড়িয়ে দেয়। ফলে গুজব আর আতঙ্ক ছড়ায় না এবং কোনো ক্ষতি করতে পারে না। এখন সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়কে গুজবের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য ছড়াতে কাজ করতে হবে। তারা একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে পারে, কোনো গুজব তৈরি হলে সঙ্গে সঙ্গে সঠিক তথ্যটি সেখানে সরবরাহ করা হবে।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা নিয়মিতভাবে গুজব ছড়ানো ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল শনাক্ত করছি। কিন্তু অনেকে বিদেশ থেকে পরিচালনা করে বলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে জটিলতা হয়। এ ছাড়া লোকবলেরও অভাব রয়েছে। বিশেষ করে সাইবার ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য দক্ষ লোকবলের অভাব। র‌্যাব-পুলিশের ক্ষেত্রে সাইবার বিষয়ে একজন কর্মকর্তা দক্ষতা অর্জন করতে করতেই ভিন্ন দপ্তরে বদলি হয়ে যাচ্ছেন। গুজবসহ সাইবার স্পেসে অপরাধ প্রতিরোধে সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের দক্ষ ও আগ্রহীদের কাজে লাগানো যেতে পারে। তাহলে যে ঘাটতি রয়েছে, তা কিছুটা পূরণ করা সম্ভব।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি এএইচএম শাহাদাত হোসাইন আমাদের সময়কে বলেন, গুজব প্রতিরোধে পুলিশ নিয়মিত কাজ করছে। আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সচেতনতা তৈরিতে আমরা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিচ্ছি। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে গুজব একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারেÑ এটি মাথায় রেখে নির্বাচনী প্রশিক্ষণে পুলিশকে গুজবের বিষয়টি নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেনÑ গুজব ঠেকাতে কেবল প্রযুক্তি নয়, প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা। ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ‘র?্যাপিড রেসপন্স ফ্যাক্টচেক ইউনিট’ গঠন করা হয়। তারা দ্রুত ভুয়া তথ্য শনাক্ত করে সঠিক তথ্যটি জনগণকে জানিয়ে দেয়।

ফ্যাক্টচেক প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানারের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশে প্রচার হয়েছে- এমন ১ হাজার ৭৯৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে, গত বছর একই সময়ের তুলনায় যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। রাজনৈতিক বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ, আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা আর বৈশ্বিক একাধিক ঘটনার প্রেক্ষিতে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়েছে। এ সময়ে একক ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্যের শিকার হয়েছেন অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপতথ্যে জড়িয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম। মেটার অধীনে থাকা দুই প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে গেল ছয় মাসে যথাক্রমে ১ হাজার ৬৬১ ও ২৫৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। ইউটিউবে ৩১১টি, এক্সে ২৫৭টি এবং টিকটকে ১৩৩টি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবা ফারজানা বলেছেন, দেশের তথ্য প্রবাহকে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ রাখতে তথ্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব এখন বহুগুণ বেড়েছে। মিসইনফরমেশন, ডিসইনফরমেশন, ফেক নিউজ ও ডিপফেকের মতো অপশক্তি দৃঢ়ভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করা হবে। গুজব, অপতথ্য ও ডিপফেক প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ রুখতে কর্মকর্তারা ঢাল হিসেবে কাজ করবেন। একটি মডেল নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে হলে গুজব ও অপপ্রচার রোধে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় সাধন করে তথ্য কর্মকর্তাদের কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

গুজবের মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলসহ জাতিগত, গোষ্ঠীগত বিভেদও তৈরি করা হয়। ফ্যাক্ট চেক করা বিভিন্ন সংস্থার তথ্য মতে, পাহাড়ে সব সহিংসতার পেছনে ‘ভয়ংকর আগুন’ হিসেবে কাজ করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব। সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে সহিংসতা ঘিরে এমন ২০টি গুজব ছড়ানো হয়। গেল মাসে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ ঘিরে উত্তাল হয় খাগড়াছড়ি। এই উত্তেজনার মধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে আরও ঘোলাটে করা হয় পরিস্থিতি। ইন্দোনেশিয়া, নেপাল ও ভারতসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নানা সময়ে সংঘটিত সহিংসতার ভিডিও ও ছবি প্রকাশ করা হয় খাগড়াছড়ির ঘটনা বলে। এতে অস্থির হয়ে উঠে পাহাড়; মুখোমুখি হয়ে পড়ে পাহাড়ি-বাঙালি, যার সবশেষ পরিণতি গুইমারার রামসু বাজারে ভয়াবহ সহিংসতা এবং তিনজনের প্রাণহানি। গত কয়েক বছরে পাহাড়ে যেসব সহিংসতা হয়েছে, তার ৮০ শতাংশের পেছনেই রয়েছে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া গুজব। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, গুজব প্রতিরোধে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পাহাড়ে সংঘাত ঠেকানো কঠিন।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুজব শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশে নয়, অনেক সময় এটি অর্থ উপার্জনের মাধ্যমও হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউটিউবে মিথ্যা খবর ছড়িয়ে হাজার হাজার ভিউ নিয়ে আয় করছে কিছু চ্যানেল। অন্যদিকে কিছু গোষ্ঠী সচেতনভাবে আতঙ্ক ছড়িয়ে জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। সাধারণ মানুষ অজান্তেই সেই প্রচারণার বাহক হয়ে যায়।