টাইপ-২ ডায়াবেটিস খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার প্রভাব

ডা. এম শরীফুল আলম
১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৪৬
শেয়ার :
টাইপ-২ ডায়াবেটিস খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার প্রভাব

তরুণদের মধ্যে ইদানীং টাইপ-২ ডায়াবেটিস ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির রূপ নিয়েছে। এর অন্যতম কারণ জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং খাদ্যাভ্যাসে নেতিবাচক প্রভাব। আগে যেখানে সক্রিয় শারীরিক পরিশ্রম জীবনের অংশ ছিল, এখন তা প্রযুক্তিনির্ভর, স্থির জীবনধারার কাছে পরাজিত হচ্ছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মোবাইল, ল্যাপটপ বা টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা, বাহ্যিকভাবে প্রায় কোনো শারীরিক পরিশ্রম না করা, বাইরে খাওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি কারণে তরুণদের শরীর ও মেটাবলিজম এক ভিন্ন সংকটে পড়ছে। দেশের ব্যাপক তরুণগোষ্ঠীর দেখা দিচ্ছে টাইপ-২ ডায়াবেটিস।

টাইপ-২ ডায়াবেটিস এমন একটি অবস্থা, যখন শরীর ঠিকঠাক ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল না হলে একে বলা হয় ইনসুলিন রেজিস্টেন্স। এ অবস্থায় শরীর রক্তে থাকা গ্লুকোজ কোষে গ্রহণ করে শক্তিতে রূপান্তর করতে পারে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায় এবং ধীরে ধীরে তা ডায়াবেটিসে রূপ নেয়।

তরুণদের মধ্যে ইনসুলিন রেজিস্টেন্স হওয়ার পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণ হলোÑ অতিরিক্ত ওজন, বিশেষ করে পেটের চর্বি (অ্যাবডোমিনাল ফ্যাট) ইনসুলিনের কার্যকারিতা হ্রাস করে। এছাড়া যদি কোনো পরিবারের বাবা-মা বা নিকটাত্মীয়ের টাইপ-২ ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মও এ রোগ হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তবে খাদ্যাভ্যাসও বড় ভূমিকা রাখে। বর্তমানে তরুণরা প্রক্রিয়াজাত, ফাস্টফুড, উচ্চ শর্করাজাতীয় এবং কোমল পানীয়সহ এমনসব খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। দিনের পর দিন এসব খাবার খেলে শরীরের ওজন বেড়ে যায়, রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

টাইপ-২ ডায়াবেটিসের কিছু লক্ষণ রয়েছে। যেমনÑ অতিরিক্ত পিপাসা অনুভব করা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, সহজে ক্লান্ত হওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, ক্ষুধা লাগলেও ওজন হঠাৎ কমে যাওয়া ইত্যাদি। তবে এ রোগ অনেক সময় নীরব ঘাতকের মতো কোনো উপসর্গ ছাড়াই শরীরের অভ্যন্তরে ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলতে পারে।

এই ভয়াবহ ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সবচেয়ে কার্যকর উপায়। প্রতিদিন অন্তত ৩০ থেকে ৪০ মিনিট নিয়মিত হাঁটা, দৌড়, সাইক্লিং কিংবা যে কোনো ধরনের শারীরিক ব্যায়াম শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি। উচ্চমাত্রার শর্করাজাতীয় ও প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করে আঁশযুক্ত সবজি, লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবার (লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি ইত্যাদি) নিয়মিত খাওয়া উচিত। পাশাপাশি আমড়া, পেয়ারা, জাম্বুরা ইত্যাদি দেশীয় ফল, যেগুলোর গ্লাইসেমিক সূচক কম, তা খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। একইসঙ্গে মিষ্টিজাতীয় খাবার, কোমল পানীয় ও অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা জরুরি। রাত না জেগে নিয়মিত ও পর্যাপ্ত ঘুমানো রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।

যদি কেউ টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন, তাহলে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত জীবনযাত্রার পরিবর্তনÑ নিয়মিত ব্যায়াম, নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং স্ট্রেসমুক্ত জীবনযাপন। তবে অনেক সময় এসব পরিবর্তন যথেষ্ট না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। তাই তরুণদের উচিত এখনই সচেতন হওয়া এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অগ্রাধিকার দেওয়া। কারণ স্বাস্থ্য জীবনের ভিত্তি এবং সচেতনতা এর প্রথম ধাপ।

লেখক : কনসালট্যান্ট, ক্লিনিক্যাল ও ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি

চেম্বার : আলোক হাসপাতাল, মিরপুর-০৬, ঢাকা। হটলাইন : ১০৬৭২