নোবেল শান্তি পুরস্কার: শান্তির ছদ্মবেশে ভূ-রাজনীতির খেলা?

মাহাদী হাসান
১২ অক্টোবর ২০২৫, ১৮:১৪
শেয়ার :
নোবেল শান্তি পুরস্কার: শান্তির ছদ্মবেশে ভূ-রাজনীতির খেলা?

প্রতি বছর অক্টোবর এলেই বিশ্বজুড়ে শুরু হয় এক ধরনের কৌতূহল— কে পাচ্ছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার? বিজ্ঞান, সাহিত্য বা অর্থনীতির পুরস্কারের চেয়ে বেশি মিডিয়া আগ্রহ দেখা যায় এখানেই। কারণ এই পুরস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে শুধু একজন ব্যক্তির অর্জন নয়, বরং একাধিক দেশের রাজনৈতিক অবস্থান, কূটনৈতিক বার্তা, আর প্রভাব বিস্তারের কৌশল।

এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ২০২৫ সালের পুরস্কার ঘোষণার আগে থেকেই আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিচুক্তি ও কোরিয়ান উপদ্বীপে কূটনৈতিক উদ্যোগের কথা তুলে ধরে ট্রাম্প বারবার নিজেকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের দাবিদার হিসেবে তুলে ধরছিলেন। এমনকি তার সমর্থকরাও ‘Trump Deserves Nobel’-এই প্রচার চালাচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরস্কার উঠেছে ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদো-র হাতে।তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো-র সরকারের বিরোধিতা করে আসছেন।

মজার বিষয় হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুরস্কার না পেলেও যুক্তরাষ্ট্র যেন তাত্ত্বিকভাবে জয়ী হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র বনাম ভেনেজুয়েলা: পুরনো সংঘাত, নতুন কৌশল

লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের পথে ভেনেজুয়েলা বরাবরই একটি কাঁটা। লাতিন আমেরিকা, বিশেষ করে ভেনেজুয়েলা, দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ের বাইরে থাকা একটি অঞ্চল। সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সমালোচকদের একজন। তিনি বলভিয়ান বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক ‘দক্ষিণের প্রতিরোধ’-এর প্রতীক হয়ে ওঠেন।

শ্যাভেজের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরি নিকোলাস মাদুরো সেই নীতিই চালিয়ে যান— তেলভিত্তিক অর্থনীতি, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, এবং ওয়াশিংটনের প্রভাব থেকে দূরে থাকা। এই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বরাবরই অস্বস্তিকর।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল মজুতকারী দেশ, যার মোট প্রমাণিত রিজার্ভ প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ব্যারেল। ১৯৯৯ সাল থেকে হুগো শ্যাভেজ এবং পরবর্তীকালে নিকোলাস মাদুরোর নেতৃত্বে দেশটি সোশ্যালিস্ট নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি এবং আর্থিক লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাড়ানো হয়। এছাড়া, মাদুরো সরকারকে 'নারকো-টেরর কার্টেল' বলে অভিহিত করে যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলাকে মাদক পাচারের কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে। এই অভিযোগ তুলে সম্প্রতি ভেনেজুয়েলা সীমান্তে মার্কিন সামরিক জাহাজ মোতায়েনের ঘটনাও ঘটেছে। 

২০১৯ সালে যখন ভেনেজুয়েলার তরুণ রাজনীতিক হুয়ান গুইদো নিজেকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্র তাকে দ্রুত স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু মাদুরো তখনও ক্ষমতায়। এরপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক চাপ কিংবা রাজনৈতিক সমর্থন সবকিছু দিয়েও মাদুরোকে টলাতে পারেনি ওয়াশিংটন।

এখন মাচাদোর নোবেল জয় সেই প্রেক্ষাপটে অনেকের কাছে ‘একটি কূটনৈতিক সাফল্য’ যা যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের প্রতিপক্ষকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়, আর মাদুরোকে আরও কোণঠাসা করে।

কারণ নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর বিজয়ীর যে বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় তা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করাও সহজ। ১৯৮৪ সালে নোবেল জয়ের পর আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু বলেছিলেন, ‘গতকালও আমাকে কেউ চিনতো না, আমার কথা কেউ শুনতো না। কিন্তু পুরস্কার পাওয়ার পর সবাই আমাকে শুনতে চায়, আমার কথা বিশ্বাস করে।’ ’

শান্তির পুরস্কার না কি কৌশলগত স্বীকৃতি?

নোবেল শান্তি পুরস্কারের ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, এর সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই কেবল মানবিকতা বা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নেওয়া হয়নি। বরং নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বার্তা পাঠানোর মাধ্যম হিসেবেই এটি ব্যবহৃত হয়েছে। বোঝা যায়, নোবেল শান্তি পুরস্কারের অনেক প্রাপকই পশ্চিমা স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

দালাই লামা (চীন)

চীনের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রতীক দালাই লামা ১৯৮৯ সালে পুরস্কার পান। তখন তিয়েনআনমেন স্কয়ারের গণঅভ্যুত্থান দমন নিয়ে চীনের ভাবমূর্তি বিশ্বজুড়ে নেতিবাচক। দালাই লামাকে পুরস্কার দিয়ে সেই সময় পশ্চিমা বিশ্ব চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরোধিতার প্রতীক তৈরি করে।

অং সান সু চি (মিয়ানমার)

১৯৯১ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের জন্য তিনি পুরস্কার পান। কিন্তু পরবর্তীতে রোহিঙ্গা নির্যাতনে তার নীরবতা এই পুরস্কারের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অনেকে বলেন, তার পুরস্কার ছিল চীনপন্থী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমা ব্লকের একটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ।

শিরীন এবাদি (ইরান)

২০০৩ সালে ইরানের মানবাধিকার আইনজীবী শিরীন এবাদি নোবেল জয় করেন। তিনি ছিলেন ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্রের কড়া সমালোচক। তখন ইরাক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ‘অক্ষশক্তির’ সদস্য ঘোষণা করেছিল। এবাদির পুরস্কার পশ্চিমা ব্লকের কাছে ইরানবিরোধী এক ‘নৈতিক জয়ের’ প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

মালালা ইউসুফজাই (পাকিস্তান)

২০১৪ সালে নোবেল পান পাকিস্তানের কিশোরী মালালা ইউসুফজাই, যিনি তালেবানের গুলিতে আহত হয়েছিলেন। একই সময়ে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা অভিযান চলছিল। মালালার পুরস্কার তখন বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতিকে এক ধরনের নৈতিক বৈধতা দিতে সাহায্য করেছিল বলে মনে করেন অনেকে।

লিউ শিয়াবো (চীন)

২০১০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান চীনের গণতন্ত্রপন্থী লেখক ও মানবাধিকার কর্মী লিউ শিয়াবো। তখন তিনি ছিলেন কারারুদ্ধ-‘চার্টার ০৮’ নামের এক গণতান্ত্রিক ঘোষণাপত্র রচনার অভিযোগে। পশ্চিমা বিশ্ব লিউ শিয়াবোকে চীনা কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু বেইজিং এটিকে দেখেছিল তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ হিসেবে। তখন নরওয়ের সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কও তিক্ত হয়ে পড়ে। অনেক বিশ্লেষক বলেছিলেন, এই পুরস্কার কেবল মানবাধিকারের স্বীকৃতি নয়, বরং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে প্রতিহত করার কৌশলগত বার্তা বহন করেছিল।

চীন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ পেরি লিংক বলেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার না পেলে লিউয়ের কোনো ইতিহাস থাকতো না। কারণ কমিউনিস্ট পার্টি সব রেকর্ড মুছে ফেলেছিল।

শুধু ব্যক্তি নয়, অনেক সময় পুরস্কার পেয়েছে সংগঠনও যেগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ): ২০১২ সালে পুরস্কার পায় “শান্তি ও ঐক্যের প্রতীক” হিসেবে, ঠিক তখনই ইউরোজোন সংকট ও ব্রেক্সিট নিয়ে ইউরোপে রাজনৈতিক ভাঙন দেখা দিচ্ছিল।

ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম: ২০২০ সালে এই সংস্থাটি নোবেল শান্তি পুরস্কার পায়, যা জাতিসংঘের একটি সংস্থা। এই সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। ফলে পুরস্কারের মাধ্যমে এই বার্তা তুলে ধরা সহজ হয় যে যুক্তরাষ্ট্র সঠিক জায়গায় অনুদান দিচ্ছে 

এ ছাড়া আরও কিছু পুরস্কারকে ঘিরেও বিতর্ক রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পুরস্কার। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাত্র কয়েক মাস পরই শান্তি পুরস্কার পান, যখন তিনি তখনও আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পরে নিজেই বলেছেন, ‘আমি এই পুরস্কারের যোগ্য ছিলাম না।’

বারাক ওবামাকে যখন নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় তখন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা নিবন্ধে রাজনীতি বিশ্লেষক স্টিভেন এরল্যাঙ্গার ও শেরিল গে বলেছিলেলে মার্কিন নেতৃত্বকে সমর্থন জানিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করল নোবেল কমিটি।

এছাড়া ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ (২০১৯) এর পুরস্কার পাওয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।  ইরিত্রিয়ার সঙ্গে শান্তি চুক্তির জন্য তিনি পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু পরের বছরই তার নেতৃত্বে টিগ্রে অঞ্চলে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, হাজারো মানুষ নিহত হন।

এমন বহু উদাহরণ প্রমাণ করে, নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রায়ই হয়ে দাঁড়ায় কূটনৈতিক বার্তা পাঠানোর উপায় কে ‘শান্তির দূত আর কে বিশ্বের খলনায়ক’, তা নির্ধারণের এক পশ্চিমা মানদণ্ড।

নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনলজির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ তোরজোনে নাটসেন বলেন, ‘এই পুরস্কার রাজনীতিবিদদের এমন এক বৈশ্বিক পরিচয় দেয় যা ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সহজতর করে।’