বাংলাদেশের প্রস্তুতি স্বাধীনভাবে মূল্যায়ন করবে জাতিসংঘ
এলডিসি থেকে উত্তরণ
সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটার কথা। এ ক্ষেত্রে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি মূল্যায়ন ও সম্ভাব্য বহিরাগত ঝুঁকি শনাক্তে জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি স্বাধীন মূল্যায়ন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকারের মতে, এ উদ্যোগ দেশের প্রস্তুতি যাচাই ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আস্থা বাড়াতে সহায়ক হবে।
গত মাসের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের প্রস্তুতি, বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা এবং উত্তরণ-পরবর্তী সম্ভাব্য বহিরাগত ধাক্কা ও ঝুঁকির বিষয়ে একটি স্বাধীন মূল্যায়ন পরিচালনার অনুরোধ জানিয়েছে সরকার। সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘও একটি স্বাধীন বিশ্লেষণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, জাতিসংঘের অফিস অব দ্য হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ফর দ্য লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিজ (ইউএন-ওএইচআরএলএলএস) এ বিষয়ে এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সংস্থাটি।
চিঠিতে বলা হয়েছে- এ মূল্যায়নের লক্ষ্য হবে একটি নিরপেক্ষ ও সামগ্রিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা, যেখানে সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত, বহিরাগত ধাক্কা সামলানোয় বাংলাদেশের সক্ষমতা যাচাই এবং উত্তরণ প্রক্রিয়াটি মসৃণ ও টেকসই হবে- এমন আস্থা তৈরি করা যায়।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
এদিকে দেশের ব্যবসায়ীরা এলডিসি থেকে উত্তরণের এ প্রক্রিয়া অন্তত তিন বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করে আসছেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার বিষয়টি আমাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে না। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসিতে (সিডিপি) এলডিসি উত্তরণ নিয়ে তৃতীয় পর্যালোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। পেছানোর জন্য যুক্তি দিয়ে তাদের বোঝাতে হবে। এ ছাড়া সব ধরনের সুবিধা এখনই উঠে যাবে না। ওষুধ ও প্যাটেন্টের ওপর বিদ্যমান সুবিধা উঠে যাবে, বিষয়টি নিয়ে করণীয় ঠিক করে পদক্ষেপ নিতে হবে। বসে না থেকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
জানা গেছে, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধার কোনো সম্পর্ক নেই। উত্তরণের পরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেবে। পাশাপাশি কানাডা, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও এ সুবিধা অব্যাহত রাখবে। ফলে রপ্তানি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা নেই এবং ব্যবসায়ীদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। এর আগে জাতিসংঘ আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তুতিসংক্রান্ত প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি দিয়েছে।
জানা গেছে, এ বিষয়ে খোদ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নজরদারি করছেন। গত ৮ অক্টোবর এ নিয়ে বৈঠকও করেছেন তিনি। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা যেন নিজেদের পায়ে নিজেরা দাঁড়াতে পারি। আমাদের যেন কোনো ধরনের দাসত্ব করতে না হয়। এটা পরিষ্কার হতে হবে, আমরা আর পরনির্ভর থাকতে চাই না। আমাদের স্বনির্ভর হতে হবে। আমাদের যে ডেডলাইনই থাকুক না কেন, আমাদের আসলে স্বনির্ভর হতে হবে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
প্রধান উপদেষ্টার বরাত দিয়ে তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, এখন যেহেতু পরনির্ভর হয়ে আছি, এ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হওয়ার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এর বাইরে আমাদের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য আমাদের অভ্যাস পাল্টাতে হবে। আত্মনির্ভর হতে গেলে বুদ্ধি খাটাতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে, লড়াই করতে হবে। এটা কঠিন হলেও এ কাজে আনন্দ আছে। তিনি আরও বলেন, আমরা যে নতুন বাংলাদেশের কথা বলি, নতুন বাংলাদেশ মানে হলো স্বনির্ভর বাংলাদেশ। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য এ জাতির যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। তারুণ্য, সৃজনশীলতা আমাদের শক্তি। এ শক্তি আর সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। আত্মনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলে জাতিকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে।
জানা গেছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদনটি জাতিসংঘে জমা দেওয়া হবে। বর্তমানে প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে। অংশীজনদের মতামত নিয়ে তা চূড়ান্ত করে জাতিসংঘে পাঠানো হবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, সরকার জাতিসংঘকে একটি স্বাধীন পর্যালোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা ব্যবসায়ী মহল একটি নিরপেক্ষ প্রতিবেদন আশা করছি, যেখানে তিনটি ইনডিকেটর থেকে দুটির (মাথাপিছু আয় ও অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ সূচক) যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। আমরা যদি এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা দেখি, তাহলে দেখা যাবে, তাদের অভিজ্ঞতাও খুব ইতিবাচক নয়। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, মার্কিন শুল্ক যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জ্বালানি সংকট এবং কোভিড-১৯ এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিবেচনায় এখন হয়তো উত্তরণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় নয়। এটি বরং অকালপক্ক গ্র?্যাজুয়েশন ও স্থবিরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এ জন্য বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ কমপক্ষে তিন বছর পিছিয়ে দেওয়া উচিত। এতে দেশের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা শক্তিশালীকরণ, প্রয়োজনীয় পলিসিগুলো যুগোপযোগীকরণ এবং বেসরকারি খাতকে প্রস্তুতকরণে প্রয়োজনীয় সময় পাওয়া যাবে।