স্তন ক্যানসার : সুস্থ হতে ধৈর্য রাখতে হবে: তৈয়বা বেগম লিপি

মুখোমুখি

লাবণ্য লিপি
১২ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
স্তন ক্যানসার : সুস্থ হতে ধৈর্য রাখতে হবে: তৈয়বা বেগম লিপি

অক্টোবর মাস স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং অন্য সংগঠনগুলোর মতে, স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাসের এবারের (২০২৫ সালের) প্রতিপাদ্য হলো- প্রতিটি গল্পই অনন্য, প্রতিটি যাত্রা গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে যে মেসেজটি আমরা পাই তা হলো, স্তন ক্যানসারের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা. সহনশীলতা এবং আগামীর প্রত্যাশা তুলে ধরে এবং আক্রান্ত সবার জন্য সহানুভূতি, সম্মান ও সমান চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া। স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাসে ক্যানসারজয়ী এক যোদ্ধার গল্প শোনাচ্ছেন লাবণ্য লিপি

তৈয়বা বেগম লিপি। একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী ও বৃত্ত আর্টসের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি একজন ক্যানসারজয়ী। দীর্ঘ একটা জার্নির পর সুস্থ হয়ে আবার কাজে ফিরেছেন। কিন্তু এই কাজে ফেরাটা খুব সহজ ছিল না। দীর্ঘ সময় অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে চিকিৎসা শেষে তিনি ক্যানসারমুক্ত হতে পেরেছেন। বলতে গেলে প্রতিনিয়তই নিজের শরীর ও মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কেমন ছিল সেই যুদ্ধ? চলুন শুনি তার মুখ থেকেই-

২০২৩ সালের নভেম্বরে আমার ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পড়ে। বিষয়টা এতটাই হঠাৎ ধরা পড়ে যে, তার জন্য আমি মোটেও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। আমি তখন কানাডার টরন্টোতে ছিলাম। একদিন গোসল করতে গিয়ে হঠাৎ বুকে সাবান মাখতে গিয়ে আমি অনুভব করি বুকে বেশ শক্ত ও বড় একটা চাকা। তখনও আমি ভয় পাইনি। তবে মনে একটা সন্দেহ ঢুকে যায়। আমার এক বন্ধু ছিল ওদেশে। সে একজন নার্স। আমি ওকে ফোন করে ডাকলাম। ও এলে সবটা খুলে বললাম। ও তখন আমার বুকে হাত দিয়ে পরীক্ষা করল। আমি খেয়াল করলাম মুহূর্তেই ওর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আমার তখন দেশে ফেরার সময় হয়ে গেছে। ও আমাকে বলল, তোমাকে অতিদ্রুত ডাক্তার দেখাতে হবে। তুমি এখানে আছো আর চার-পাঁচ দিন। এখানে তো ডাক্তার দেখাতে সময় লাগে। তুমি দেশে ফিরে আগে ডাক্তার দেখাবে। কিন্তু আমি দেশে ফেরার পর আমার ভীষণ জ¦র হলো। এতটাই জ¦র যে, ডাক্তারের কাছেও যেতে পারছিলাম না। কয়েকদিন পর জ¦র কমলে ডাক্তারের কাছে গেলাম। সব শুনে সে কিছু টেস্ট দিল। সেই টেস্টে ধরা পড়ল আমি ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত। ডাক্তার তো তখনই অপারেশন করতে সাজেস্ট করল। কিন্তু আমরা অস্থির না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করলাম কী কী করব। আমার হাসবেন্ড মাহবুব ভারতের একটা হাসপাতালে সব কাগজপত্র পাঠালেন। তারা কিছু পরামর্শ দিলেন। দেশেও একজন ক্যানসার বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কনসাল্ট করলাম। তিনি সাজেস্ট করলেন আগে কেমো শুরু করতে এবং বললেন, আপনার যেহেতু সামর্থ্য আছে তাই একবার থাইল্যান্ডে যান। ওখানে কী বলে দেখেন। প্রথম কেমোটা আপনি ওখানে দিন। তারপর ওদের পরামর্শ অনুযায়ী আমরা বাকিগুলো দেব। আমরা তাই করলাম। থাইল্যান্ড চলে গেলাম। ওখানে ডাক্তার দেখালাম। ওদের এবং বাকি সবার পরামর্শ প্রায় একইরকম হলো। ওরা কেমো শুরু করল। ওরা দুই ভাগে চারটা চারটা আটটা কেমো রুটিন করে দিল। কেমো নিয়ে দেশে এসে আবার নির্ধারিত সময়ে দেশেও কেমো দেওয়া হলো। তখন শুরু হলো চেহারার পরিবর্তন। আমি জানতাম চুল পড়ে যাবে। তাই চুল আগেই কেটে ফেললাম। আসলে আমি অনেক কিছু আগেই ভেবে রেখেছিলাম। মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। তাই ভেঙে পড়িনি। কেমো শেষ হলে ক্যানসার যখন অনেকটা সংকোচন করা হলো তখন সিদ্ধান্ত হলো অপারেশনের। আমরা আবার বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করলাম। আমেরিকায় আমার এক বন্ধু আছে জিনাত ইকরামুল্লা। সে দুবার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিল। আমরা তার পরামর্শ চাইলাম। সে থাইল্যান্ডের একটা হাসপাতালের কথা বলল। সেখানে অপারেশন খুব ভালো হয়। আমরা সেখানে যোগাযোগ করে চলে গেলাম। অপারেশন হলো। আমার সেই ডাক্তার এতটাই আন্তরিক ছিলেন, আমি তাকে ভুলতে পারি না। কারও তাকে ডাকা লাগেনি। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে এসে নিজহাতে ড্রেসিং করে দিতেন। নার্স পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। এ ছাড়া ঘণ্টায় ঘণ্টায় নার্স এসে বিপি মাপত, সবকিছু চেক করত। আমি ঘুমের ঘোরেও টের পেতাম। দেশে ফেরার পর শুরু করলাম রেডিও থেরাপি। কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপি, প্রতিটা পর্যায়ই ভীষণ কষ্টকর। শরীরে ব্যথাসহ নানারকম অস্বস্তি হয়। তখন আমাদের বন্ধুরা আসত আমাদের বাসায়। ওরা কিন্তু কেউ মেহমান হয়ে আসত না। ওরা এসে কেউ রান্না করত, কেউ এটা-ওটা কাজ করত, কেউ বা আমার পা টিপে দিত, ঘাড় টিপে দিত। সব সময় গল্প বলে আমাকে চাঙ্গা করে রাখত। আমি ওদের ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না। নির্দিষ্ট সময় চিকিৎসা শেষে আবার সব টেস্ট করে জানা গেল আমার শরীরে আর ক্যানসার নেই। তবু কিন্তু বেশ কিছুটা সময় সাবধানে থাকতে হয়েছে। একা কোথাও যাইনি। এখন আবার শুরু করেছি একা বের হওয়া। দেশের বাইরেও গেলাম একবার। সামনে আবার যাব। যাহোক আমার মনে হয় আমি যেন দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি। বোনাস এই জীবনটা আমি তাই নিজের মতো করে উপভোগ করতে চেষ্টা করছি। আসলে আগে-পরে সবাইকে চলে যেতে হবে। তবে যতদিন জীবন আছি ততদিন আনন্দ নিয়ে বাঁচতে হবে। ক্যানসার হলেই জীবন শেষ, এমন না ভেবে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া উচিত। পরিবারের সবার সহযোগিতা এ সময় খুব দরকার। আর দরকার অসীম ধৈর্য। তাহলেই ক্যানসার জয় করা সম্ভব।