থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যার সঙ্গে শিশুর অটিজমের সম্পর্ক

ডা. রাসেল আক্তার
১২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:১৫
শেয়ার :
থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যার সঙ্গে শিশুর অটিজমের সম্পর্ক

মানবদেহে থাইরয়েড গ্রন্থি দেখতে একটি ছোট, প্রজাপতির মতো। গলার সামনের দিকে অবস্থান করে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অন্তঃস্রাবী গ্রন্থি। এ থেকে নিঃসৃত হরমোন, বিশেষ ট্রাইআইওডোথাইরোনিন (T4) ও থাইরোক্সিন (T4) দেহের বিপাকপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে করে। পাশাপাশি মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গর্ভাবস্থায় এ হরমোন ভ্রƒণের স্নায়ুতন্ত্র, মস্তিষ্কের গঠন, শেখার ক্ষমতা বিকাশে প্রয়োজনীয়। অথচ আমরা অনেক সময় এ গ্রন্থির কার্যকারিতা বা তার সমস্যা অবহেলা করি। এ কারণে দেখা দিয়ে থাকে দীর্ঘমেয়াদি জটিল শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। এর একটি হলো অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (ASD)। গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতীর শরীরে যদি থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি থাকে, তাহলে ভ্রƒণের মস্তিষ্কে নিউরোনের গঠন ও সংযোগ ঠিকমতো হয় না। ফলে শিশুর সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, ভাষা ও যোগাযোগ দক্ষতা এবং সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া বিকলাঙ্গ হয়ে পড়তে পারে। এগুলো অটিজমের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একইভাবে, হরমোনের অতিরিক্ততা হাইপারথাইরয়ডিজম তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও আচরণগত বিকাশেও বিঘ্ন ঘটাতে পারে। এর প্রভাবও পরোক্ষভাবে অটিজমের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। এছাড়া, আয়োডিন নামক খনিজ পদার্থটি থাইরয়েড হরমোন তৈরির একটি অপরিহার্য উপাদান। যদি মায়ের খাদ্যে পর্যাপ্ত আয়োডিন না থাকে, তাহলে হরমোন উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। এই ঘাটতিতে শিশুর মস্তিষ্ক গঠনের প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক উন্নয়নশীল দেশে আজও আয়োডিনের ঘাটতি একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা যায়, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে আয়োডিনযুক্ত লবণের ব্যবহার এখনও সর্বজনীন নয়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অটোইমিউন থাইরয়েড রোগ। এ অবস্থায় মায়ের শরীর নিজের থাইরয়েড গ্রন্থিকে ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এ অ্যান্টিবডিগুলো গর্ভস্থ শিশুর স্নায়ুতন্ত্রে পৌঁছে সেখানে স্নায়বিক সংযোগে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। ফলে শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং পরবর্তী সময় তার আচরণে অটিজমের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেতে পারে।

পরিবেশ ও জিনগত প্রভাবও থাইরয়েড সমস্যার সঙ্গে মিলে অটিজমের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। কিছু জিন মায়ের হরমোন উৎপাদন ও রিসেপ্টরের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলে। ভারী ধাতু, কীটনাশক বা পরিবেশ দূষণকারী রাসায়নিক পদার্থও থাইরয়েডের কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে। এসব প্রভাব যদি একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। তবে এ সমস্যা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়েই মায়ের থাইরয়েড পরীক্ষা করানো উচিত। থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা যদি স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করতে হবে, নিয়মিত ফলো-আপ করতে হবে। দৈনন্দিন খাদ্যে আয়োডিনযুক্ত লবণের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে হরমোন উৎপাদনে ঘাটতি না হয়।

মায়ের শরীরে হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকলে গর্ভের শিশুর মস্তিষ্ক সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হয়। অটিজমের ঝুঁকিও হ্রাস পায়। তাই থাইরয়েড সমস্যা অবহেলা না করে সময়মতো সঠিক পরীক্ষা, খাদ্যাভ্যাস এবং চিকিৎসা নিশ্চিত করা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : অটিজম গবেষক ও চিকিৎসক

চেম্বার : ফার্ম ভিউ সুপার স্পেশালিটি ক্লিনিক

২০৫ ফার্মগেট সুপার মার্কেট, ঢাকা

০১৮১৩৩২৬৫৯৫; ০১৭২৪৮৮৬৫৩৯