বড় অগ্রগতি, শান্তি কতদূর
অবশেষে আপাত রক্ষা। স্বস্তির নিঃশ^াস পড়ছে গাজা ও তেল আবিবে। হলো বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি। এ এক ঐতিহাসিক ক্ষণ। থামছে অশ্রুপাত, বন্ধ হচ্ছে রক্তপাত। যেন এক শতাব্দীর অপেক্ষার অবসান হলো। টানা দুই বছর ধরে একতরফা যে ভয়াবহ মৃত্যু মিছিল চলছিল গাজার আকাশে-বাতাসে, এই উপত্যকা এখন শান্ত হচ্ছে। আপাতত। আজ সেখানে ধ্বংসস্তূপের ওপরে আলোর রেখা পড়েছে। জীবিত হোক আর মৃত জিম্মিরা মুক্তি পাচ্ছে বলে বাঁধভাঙা উল্লাস তেল আবিবেও। কিন্তু অবিশ^াসও অগাধ। স্বাধীনতাকামী গাজাবাসী ও শান্তিকামী বিশ^বাসীর এখন একই প্রশ্ন : এই শান্তি কি স্থায়ী হবে?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০-দফা পরিকল্পনার প্রথম ধাপে চুক্তিতে আগ্রাসী দেশ ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস রাজি হওয়ার পর গতকাল দুপুর থেকে গাজায় শান্তির আবহ তৈরি হয়। নিজের মালিকানাধীন সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প নিজেই এই ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা এই চুক্তি কার্যকরের পক্ষে ভোট দেয়। এর আগ পর্যন্ত ইসরায়েল তার কদর্য চেহারা দেখিয়েছে, গাজা নগরীতে হামলা করে মানুষের প্রাণ ঝরানো অব্যাহত রেখেছিল।
প্রেক্ষাপট : হামাস প্রায় দুই দশক ধরে গাজা শাসন করে আসছে। দীর্ঘ ছয় দশকের শ^াসরুদ্ধকর অবরোধ ও অব্যাহত ইসরায়েলি নিপীড়নের জবাব হিসেবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর তারা শত্রুরাষ্ট্রের ভেতরে ঢুকে একটি উৎসবে সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে ১১৩৯ জন নিহত হন। তারা ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। জিম্মিদের কজন এখনও তাদের হাতে জীবিত বন্দি আছেন। যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে এদের মধ্যে ২০ জন মুক্তি পাবেন।
ওই দিন থেকেই হামাসকে নির্মূলে গাজায় সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। দুই বছরের এই যুদ্ধে ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার মানুষ। এমনকি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পরিসংখ্যান মতে, ৭৫ শতাংশেরও বেশি নিহত ব্যক্তি হামাসের যোদ্ধা নয়। বরং নিরস্ত্র নারী ও নিরীহ শিশুর সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের মতো।
গাজা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০২৩ সালের ২১ নভেম্বর নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। হেগভিত্তিক এই আদালতের এখতিয়ার ইসরায়েল অস্বীকার করে আসছে এবং গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগকে মিথ্যা দাবি করে আসছে।
ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা : যুদ্ধবিরতির এই চুক্তি ঘোষণা করে গতকাল ট্রাম্প জানান, গাজায় আটক সব জিম্মিকে খুব শিগগির মুক্তি দেওয়া হবে এবং ইসরায়েল একটি ‘শক্তিশালী, দীর্ঘস্থায়ী ও চিরস্থায়ী শান্তি’র প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সম্মত সীমারেখায় সেনা প্রত্যাহার করবে। হামাস ২০ জন জিম্মিকে মুক্তি দেবে। বিনিময়ে ইসরায়েল দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে; এদের মধ্যে ২৫০ জন যাবজ্জীবন সাজা নিয়ে ইসরায়েলের জেলে বন্দি আছেন। তবে ইসরায়েল জানিয়েছে, এই চুক্তির অংশ হিসেবে বিশিষ্ট ফিলিস্তিনি নেতা মারওয়ান বারগুতিকে মুক্তি দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।
আরও পড়ুন:
রোগীর পেটে জীবন্ত মাছি!
গাজা ও তেল আবিবে আনন্দ ও অবিশ^াস : এই যুদ্ধবিরতি গাজাবাসীর মনে স্বস্তি এনে দিয়েছে। তবু তাঁদের মনে একই সঙ্গে আনন্দ ও অবিশ্বাস, চুক্তিটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে জীবন ও আশা জেগে উঠবে হয়তো। ইসরায়েলে জিম্মিদের অপেক্ষায় থাকা পরিবারগুলোর মধ্যেও তাৎক্ষণিক স্বস্তি ও আনন্দের বন্যা এনে দিয়েছে এই অগ্রগতি। পাশাপাশি তাঁরা এই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার জন্য ট্রাম্পকে নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া : ইসরায়েল ও হামাস গাজা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সম্মত হওয়ায় বিশ্বনেতারা এই খবরকে স্বাগত জানিয়েছেন। নেতানিয়াহু এই চুক্তিকে ‘ইসরায়েলের জন্য বড় দিন’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের জিম্মিদের মুক্ত করার এই পবিত্র মিশনের প্রতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর দলের নিষ্ঠার জন্য আমি মন থেকে ধন্যবাদ জানাই।’ আরব বিশে^র কাছে হামাস আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন ‘দখলদার ইসরায়েলি সরকারকে চুক্তির অধীনে বাধ্যবাধকতাগুলো সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করে।’
হামাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহ আন্দোলনের প্রধান, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও ট্রাম্পের এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ‘এই প্রচেষ্টা একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর সূচনা হিসেবে বিবেচিত হবে, যা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র থেকে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান এবং একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেবে।’
বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া : চুক্তির ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প বলেছেন, ‘আরব ও মুসলিম বিশ্ব, ইসরায়েল, আশপাশের সব দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন’। তিনি বলেন, ‘এই ঐতিহাসিক ও অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটাতে আমাদের সঙ্গে কাজ করার জন্য কাতার, মিশর ও তুরস্কের মধ্যস্থতাকারীদের ধন্যবাদ জানাই।’
মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি বলেছেন, ‘বিশ্ব একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হলো। এই চুক্তিটি কেবল যুদ্ধের অধ্যায়ই বন্ধ করবে না। এটি ন্যায়বিচার ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করবে। ভবিষ্যতের জন্য এই অঞ্চলের জনগণের কাছে আশার দরজা খুলে দেবে।’
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান যুদ্ধবিরতির দিকে ‘ইসরায়েলি সরকারকে উৎসাহিত করার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা’ প্রদর্শনের জন্য ট্রাম্পের প্রশংসা করেন।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার বলেছেন, এই চুক্তিটি ‘গভীর স্বস্তির’ একটি মুহূর্ত যা ‘সারা বিশ্বে অনুভূত হচ্ছে।’ তিনি সব পক্ষের প্রতি তাঁদের করা ‘প্রতিশ্রুতি পূরণ, যুদ্ধ শেষ করা এবং সংঘাতের একটি ন্যায্য ও স্থায়ী সমাপ্তির ভিত্তি তৈরি করা’র আহ্বান জানান।
একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দেওয়া ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন বলেছেন, এই চুক্তি ‘অবশ্যই যুদ্ধের সমাপ্তি এবং দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ওপর ভিত্তি করে একটি রাজনৈতিক সমাধানের সূচনাকে চিহ্নিত করবে।’ ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন পর এই অঞ্চলে শান্তির একটি বাস্তব সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।’
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের একজন সোচ্চার সমালোচক স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘এখন সংলাপ শুরু করার, বেসামরিক জনগণকে সহায়তা করার এবং ভবিষ্যতের দিকে আশা নিয়ে তাকানোর সময় এসেছে। নৃশংসতার আর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই চুক্তিকে একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন- জাতিসংঘ চুক্তির ‘সম্পূর্ণ বাস্তবায়নকে’ সমর্থন করবে, তার মানবিক সহায়তা বিতরণ বৃদ্ধি করবে এবং গাজায় তার পুনর্গঠনের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘দুর্দশার অবসান ঘটাতে হবে।’
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
দীর্ঘ দুই বছর ধরে চলা মৃত্যুমিছিল অবশেষে স্তব্ধ। ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির রক্তে ভেজা গাজার আকাশ আজ শান্ত। এ যেন এক ঐতিহাসিক ক্ষণ। এখন শান্তি স্থায়ী হয় কি না, তা-ই দেখার বিষয়। মনে করিয়ে দিই- এ বছর মার্চে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় নিরীহ নারী ও শিশু এবং নিরস্ত্র সাধারণ ফিলিস্তিনিদের ওপর আবার আগ্রাসন, বর্রবতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ শুরু করে নেতানিয়াহুর সামরিক বাহিনী।