শিক্ষা ক্যাডারে অসন্তোষ

এম এইচ রবিন
০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
শিক্ষা ক্যাডারে অসন্তোষ

শিক্ষা প্রশাসনের ভেতরে নীরব অস্থিরতা এখন প্রকাশ্য আলোচনার বিষয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক (ডিজি) দায়িত্বে থাকাকালেই একই পদে নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সরকারি চাকরির নীতিমালা অনুযায়ী এটি সম্ভব হলেও সময়, প্রেক্ষাপট ও প্রক্রিয়া নিয়ে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এছাড়া শিক্ষকদের বদলি ও পদায়নের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে চলে যাওয়াসহ সাম্প্রতিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগের পর তাঁরা নিজেদের ‘কোণঠাসা’ অবস্থায় মনে করছেন।

তাঁদের ভাষায়, যে অফিসের প্রধান এখনও দায়িত্বে আছেন, তাঁর পদে নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা মানে কার্যত তাঁকে অগ্রাহ্য করা। এটি প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদাকে খাটো করে।

মাউশির বর্তমান মহাপরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খান সম্প্রতি স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে অব্যাহতির আবেদন করেছেন। এর আগেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে নতুন ডিজি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া অনেকের চোখে এক ধরনের ‘প্রশাসনিক চাপ’ ও ‘মনস্তাত্ত্বিক বার্তা’।

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন সব প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ হাতে নিচ্ছে। অধিদপ্তরকে প্রায় অকার্যকর করে ফেলা হচ্ছে। এমনকি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন সবকিছু মন্ত্রণালয়ের একক নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।

বদলি ও পদায়নে মন্ত্রণালয়ের একক ক্ষমতা : সম্প্রতি জারি হওয়া ‘সরকারি কলেজ শিক্ষক বদলি-পদায়ন নীতিমালা ২০২৫’ অনুযায়ী প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত বদলির সম্পূর্ণ ক্ষমতা এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে। আগে এই কাজটি মাউশি ও মন্ত্রণালয় যৌথভাবে করত। নতুন নীতিতে বলা হয়েছেÑ বদলি আবেদন করতে হবে নির্ধারিত অনলাইন পোর্টালে এবং প্রতিটি আবেদন যাচাই ও অনুমোদন করবে সরাসরি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ।

এই পরিবর্তনকে শিক্ষক সমাজের অনেকেই স্বাগত জানালেও বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা একে ‘কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের ফাঁদ’ বলছেন। বাংলাদেশ সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির এক কর্মকর্তা বলেন, একদিকে বলা হচ্ছে অনলাইনে বদলি হবে, প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবেÑ কিন্তু বাস্তবে কর্মকর্তাদের নিজস্ব মূল্যায়ন, অধিদপ্তরের মতামত সবকিছু উপেক্ষা করে মন্ত্রণালয়ের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হলো। এতে স্বচ্ছতা নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ বাড়বে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবশ্য বলেছে, এই পরিবর্তন আনতে হয়েছে বদলি প্রক্রিয়ায় গতি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের এক যুগ্ম সচিব নাম প্রকাশ না করে জানান, ‘শিক্ষা ক্যাডারে বদলি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ বহুদিনের। নতুন নীতিমালা এই প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল ও কেন্দ্রীভূত করেছে, যাতে রাজনৈতিক প্রভাব ও মানবিক অনুরোধের অজুহাতে আর ফাইল স্থগিত না থাকে।’ তবে শিক্ষক সমাজের অনেকেই মনে করছেন, এই বক্তব্য বাস্তবতার প্রতিফলন নয়।

মাউশি বিভাজনের প্রস্তাব : শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর’কে ভেঙে আলাদা ‘মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে মাউশির দায়িত্ব ও জনবল উভয়ই কমে আসবেÑ এমন আশঙ্কা করছেন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা।

মাউশির একজন উপ-পরিচালক বলেন, ‘আমাদের অফিসের জনবল ও দায়িত্ব কমানোর মধ্য দিয়ে শিক্ষা ক্যাডারের প্রশাসনিক গুরুত্বকে ইচ্ছাকৃতভাবে হ্রাস করা হচ্ছে। মাউশি দীর্ঘদিন ধরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উভয় স্তরে নীতিমালার প্রয়োগ নিশ্চিত করেছে, এখন সেটিকে ভেঙে দিলে সমন্বয় ভেঙে পড়বে।’

শিক্ষাবিদরাও এই সিদ্ধান্তকে ‘অযৌক্তিক তড়িঘড়ি উদ্যোগ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। শিক্ষাবিদ ড. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, অধিদপ্তর বিভাজন করতে হলে আগে একটি পূর্ণাঙ্গ স্টাডি করতে হয়Ñ মানবসম্পদ, বাজেট, প্রশিক্ষণ কাঠামো ও তদারকির ভারসাম্য বিবেচনায়। শুধু প্রশাসনিক স্বার্থে এমন বড় পরিবর্তন করলে শিক্ষা প্রশাসনে দীর্ঘমেয়াদি বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।

‘কোণঠাসা’ হয়ে পড়ছে শিক্ষা ক্যাডার : একাধিক সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক এই সিদ্ধান্তগুলোর পর শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিজেদের ‘কোণঠাসা’ অবস্থায় মনে করছেন। পদোন্নতি স্থগিত, বদলির জটিলতা ও নিয়োগের অনিশ্চয়তার মধ্যে তাদের পেশাগত আত্মবিশ্বাসও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারি না, কারণ সবাই সরকারি চাকরিজীবী। কিন্তু ফোরাম ও সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে, শিক্ষা ক্যাডারের মর্যাদা ধীরে ধীরে কমানো হচ্ছে। যে নীতিনির্ধারণে আমরা সক্রিয় অংশীদার ছিলাম, এখন সেখানে আমাদের মতামত নেওয়া হয় না।’ তিনি আরও বলেন, শিক্ষা খাতের শক্তি হলো শিক্ষকের অভিজ্ঞতা। অথচ এখন নীতি হচ্ছেÑ শিক্ষক নয়, কেবল প্রশাসন ক্যাডার নির্ধারণ করবে শিক্ষা প্রশাসনের ভবিষ্যৎ। এটি বিপজ্জনক প্রবণতা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তাদের দাবি ‘এগুলো কাঠামোগত সংস্কার।’

একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয় কারও মর্যাদা হ্রাস করতে চায় না। প্রশাসনিক দায়ভার ও সমন্বয় বাড়াতে নীতিগত পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী প্রক্রিয়াগুলো আধুনিকায়ন করা জরুরি।

তবে এই আশ্বাসে শান্ত হতে পারছেন না শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তাঁদের ভাবনাÑ ‘যদি প্রতিটি নীতি, বদলি, পদায়ন ও নিয়োগ সিদ্ধান্ত সরাসরি মন্ত্রণালয় থেকে হয়, তাহলে অধিদপ্তরের অস্তিত্ব কেবল আনুষ্ঠানিক হয়ে যাবে।’

বাংলাদেশের শিক্ষা প্রশাসন আজ একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। পরিবর্তনের নামে যদি প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা, স্বায়ত্তশাসন ও দায়িত্বের ভারসাম্য নষ্ট হয়, তাহলে শিক্ষার মানোন্নয়ন নয়, বরং বিভাজনই হবে বড়।