রপ্তানির আড়ালে পাচার ১৩৬৫৫ কোটি টাকা
দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত ১২০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদেশে ১১২ কোটি ১০ লাখ ডলার পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশি অর্থে যা ১৩ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকারও বেশি। পাচারকারী অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পণ্য তৈরি করেছিল। সেই ঋণের টাকায় দেশে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানির পর মূল্যের বিপরীতে বিপুল পরিমাণ অর্থ আর ফেরত আনেনি। বরং দেশের অর্থ অবৈধভাবে বিদেশে মজুদ ও ব্যয় করেছে। অন্যদিকে দেশে হয়েছে ঋণ খেলাপি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অভ্যন্তরীণ এক প্রতিবেদন থেকে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
সিআইডি সূত্র বলছে, এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পণ্য তৈরি করেছিল। সেই পণ্য ইউরোপ ও আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। পণ্য বিক্রির এই বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ম লঙ্ঘন করে তারা আর দেশে ফেরত আনেনি। বরং বিদেশে অবৈধভাবে সম্পদ গড়ে তুলেছে এবং বিলাসবহুল বাড়িসহ আনন্দ-বিনোদনে ব্যয় করেছে। এদিকে ব্যাংক ঋণও পরিশোধ করেনি; কৌশলে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ঋণ ছাড়াও শুধু বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে পণ্য রপ্তানি করেছে। রপ্তানির আড়ালে ১৩.৫ কোটি ডলার (প্রায় ১৬৪৫ কোটি টাকা) পাচারের অভিযোগে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মানিলন্ডারিং মামলা করা হয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কয়েকটির বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান শেষে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
সিআইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১২০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পণ্য রপ্তানির আড়ালে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করেছে ক্রিসেন্ট লেদার। প্রতিষ্ঠানটির পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ১৭.২৬ কোটি ডলার (২০৯৫ কোটি টাকা)। বিসমিল্লাহ গ্রুপ পাচার করেছে ১২.৩ কোটি ডলার (১৪৯৮ কোটি টাকা), রিমেক্স ফুটওয়্যার ৬.৪ কোটি ডলার (৭৮০ কোটি টাকা), মাস্ট কর্পোরেশন ৫.৩ কোটি ডলার (৬৪৬ কোটি টাকা), আকিজ গ্রুপ ২.১ কোটি ডলার (২৫৬ কোটি টাকা), অ্যাপোলো অ্যাপারেল্স ২.৩ কোটি ডলার (২৮০ কোটি টাকা), আলফা কম্পোজিট ৫.৮ কোটি ডলার (৭০৭ কোটি টাকা), রূপালী কম্পোজিট ৫.১ কোটি ডলার (৬২১ কোটি টাকা), এসেস ফ্যাশন ২.৪ কোটি ডলার (২৯২ কোটি টাকা), ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার ও অ্যাপরেলস (ইউনিট-২) ২.৫ কোটি ডলার (৩০৫ কোটি টাকা), কন টং অ্যাপারেলস ১.৫ কোটি ডলার (১৮৩ কোটি টাকা), কাদেনা স্পোর্টসওয়্যার ১.২ কোটি ডলার (১৪৬ কোটি টাকা), প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ২.৩ কোটি ডলার (২৮০ কোটি টাকা), এসবি এক্সিম বাংলাদেশ ৩.১ কোটি ডলার (৩৭৮ কোটি টাকা), এসকিউ গ্রুপ ২.৫ কোটি ডলার (৩০৫ কোটি টাকা), বেক্সটেক্স গার্মেন্ট ২.৪ কোটি ডলার (২৯২ কোটি টাকা), হিন্দোলওয়ালী টেক্সটাইল ১.৪ কোটি ডলার (১৭১ কোটি টাকা) এবং লিনি ফ্যাশন ৩.২ কোটি ডলারের (৬২১ কোটি টাকা) পণ্য রপ্তানির পর এসব অর্থ দেশে ফেরত আসেনি।
এ ছাড়া এরিস্টোফার্মার বিরুদ্ধে ২২.৮ লাখ ডলার, এসিআইয়ের বিরুদ্ধে ২৭ লাখ, বিকন ফার্মা ২৭.২ লাখ, কেয়া গ্রুপ ৪১.৮ লাখ এবং হবিগঞ্জ এগ্রোর ৭৮.৭ লাখ ডলার রপ্তানি পণ্যের অর্থ দেশে ফেরত আনেনি।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে বিক্রির অর্থ অনেক কোম্পানি দেশে আর ফেরত আনেনি। এ ধরনের কোম্পানিগুলো শনাক্ত করেছে সিআইডি। তিনি বলেন, অপরাধের সংখ্যার তুলনায় তদন্ত করার লোকবল কম। তাই কোম্পানিগুলোর পাচারের ঘটনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমরা অনুসন্ধান করছি। অনুসন্ধান শেষে অর্থপাচারকারী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের মামলা করা হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্ত আগে কিংবা পরে হতে পারে। কিন্তু অর্থপাচারকারী কোনো কোম্পানিই তদন্তের বাইরে থাকবে নাÑ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন জসীম উদ্দিন খান।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
সিআইডি সূত্র বলছে, বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গত ১৫ বছরে সাতটি ব্যাংক থেকে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ৩৩ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পণ্য রপ্তানি করেছে। এসব পণ্য বিক্রির বিপুল অর্থ দেশে ফেরত না এনে সালমান এফ রহমানের ছেলে সায়াম ফজলুর রহমান সৌদি আরবের দাম্মামে বিপুল অর্থ বিনিয়োগে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গড়ে তোলেন। যৌথ বিনিয়োগে দাম্মামে প্রতিষ্ঠিত বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের বেশিরভাগ অর্থ বাংলাদেশ থেকে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং ও হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হয়। ওষুধ কোম্পানির পাশাপাশি দুবাই, সিঙ্গাপুর ও ইংল্যান্ডে বিপুল বিনিয়োগ এবং বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন সায়াম রহমান। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ১৮টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানির আড়ালে বিভিন্ন দেশে ১৩.৫ কোটি ডলার পাচারের প্রমাণ পাওয়ায় মানিলন্ডারিং মামলা করেছে সিআইডি। প্রসঙ্গত, প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
বেক্সিমকো গ্রুপের ব্যাংক ঋণ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাতটি ব্যাংক থেকে ৩৩ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেওয়া হয়েছে। জনতা ব্যাংক থেকে ২১ হাজার ৬৮১ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ৫ হাজার ২১৮ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ২৯৫ কোটি, সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক থেকে ৫ হাজার ৬৭১ কোটি এবং এবি ব্যাংক থেকে ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে গ্রুপটি। এ ছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপ গত কয়েক বছরে বাজার থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা প্রতারণা ও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে।
জানা গেছে, বিসমিল্লাহ গ্রুপ রাষ্ট্রীয় মালিকানার জনতা ব্যাংকসহ পাঁচটি ব্যাংক থেকে মোট ১ হাজার ১৭৪ কোটি হাতিয়ে নিয়েছে। এ অর্থের বেশিরভাগই পাচার করা হয়েছে তোয়ালে রপ্তানির আড়ালে। এর মধ্যে জনতা ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ৫২৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
এ ছাড়া ক্রিসেন্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রতারণা, জাল কাগজপত্র তৈরি করে বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে জালিয়াতি করে জনতা ব্যাংকের ১ হাজার ৭৪৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ক্রিসেন্ট গ্রুপের কর্ণধার এমএ কাদেরসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর আগে ৯১৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে ক্রিসেন্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিদেশে পণ্য পাঠিয়ে এর বিপরীতে অর্থ দেশে ফেরত না আনা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ব্যাংক-লুটেরা। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পণ্য রপ্তানির আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। আর দেশে হয়েছে ঋণখেলাপি। রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যাংকে খেলাপির অঙ্ক ১০৮৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা। রূপালী কম্পোজিট লেদারওয়্যারের খেলাপি ঋণ ৮৭৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) সম্প্রতি এক গবেষণাপত্রে জানিয়েছে, দেশ থেকে পাচার হওয়া মোট অর্থের প্রায় ৭৫ শতাংশই বাণিজ্যের মাধ্যমে হয়। আমদানি ও রপ্তানির সময় মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এই বিপুল অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়।
বিআইবিএমের শিক্ষক আহসান হাবিব বলেন, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমদানি ও রপ্তানির সময় মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যা দেশের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ।
২০২৪ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য মতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।