আ. লীগের ৩ নেতার দখলে খুলনার দৌলতপুর লঞ্চঘাট
খুলনার ঐতিহ্যবাহী দৌলতপুর লঞ্চঘাট এখন তিন আওয়ামী লীগ নেতার দখলে। একসময় দিঘলিয়া ও দৌলতপুর এলাকার হাজারো মানুষের নদী পারাপারের একমাত্র মাধ্যম ছিল এই ঘাট। কিন্তু এখন এটি বালু, ইট ও পাথরের স্তূপে ঢেকে গেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, যুবলীগ নেতা সোহেল, ৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক কাউন্সিলর প্রিন্স এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক মীর্জা তরফদার- এই তিন নেতা বছরের পর বছর ধরে লঞ্চঘাট দখল করে অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) ও বিআইডব্লিউটিএকে বারবার জানানো হলেও ঘাট দখলমুক্ত হয়নি। প্রশাসনের এমন নীরবতায় স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
দুর্গাপূজার আগে এই দখলদারত্ব নতুনভাবে আলোচনায় আসে। প্রতি বছর ভৈরব নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের জন্য এই লঞ্চঘাট ব্যবহার করা হলেও এখন বালু-ইটের স্তূপে ঘাট প্রায় অচল। পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা বলছেন, প্রতিমা বিসর্জনের সময় কয়েক হাজার মানুষের সমাগম হয়, অথচ ঘাটে অবৈধ স্থাপনা থাকায় নিরাপদভাবে বিসর্জন দেওয়া সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। কেসিসি ও বিআইডব্লিউটিএকে বিষয়টি জানানো হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বছরের পর বছর ধরে এই তিন আওয়ামী লীগ নেতা লঞ্চঘাট দখল করে বালু, ইট ও পাথরের ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। এলাকাবাসী অভিযোগÑ ঘাটের একাংশ ভরাট করে রাখায় ভৈরব নদীতে নৌকা বা ট্রলার ভিড়ানোর সুযোগ নেই। ফলে দিঘলিয়া এলাকার মানুষ প্রতিদিন খেয়াঘাট দিয়ে বাজারে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। খেয়াঘাটটি বাজারের ভেতরে হওয়ায় যাতায়াতে বড় ভোগান্তি পোহাতে হয়। স্থানীয়রা এই ঘাট পুনরুদ্ধারের জন্য বারবার আবেদন ও আন্দোলন করলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
গত ২ অক্টোবর কেসিসি ও জেলা প্রশাসন যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে দখলদারদের একাংশ উচ্ছেদ করে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কোহিনুর জাহানের নেতৃত্বে চালানো ওই অভিযানে বালু-ইট সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই ঘাটে আবার আগের মতো দখলদারদের দেখা যায়। খুলনার এই দৌলতপুর লঞ্চঘাট একসময় জেলার তৃতীয় বৃহত্তম ও
ব্যস্ততম নদীঘাট ছিল। এখান থেকে লঞ্চে ঢাকার সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী পর্যন্ত যাতায়াত করা যেত। বিএল কলেজ ও দিবানৈশ কলেজের শিক্ষার্থীরাও এই লঞ্চঘাট দিয়েই যাতায়াত করতেন। কিন্তু ২০০০-০১ সালে যাত্রী সংকট ও লোকসানের অজুহাতে ঘাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ২০১০ সালে পন্টুন সরিয়ে নেওয়ার পর ঘাটটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে দখলদাররা জায়গা দখল করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার শুরু করে।
স্থানীয় লেখক ও সাহিত্যিক আবু আসলাম বাবু বলেন, এই লঞ্চঘাট আমাদের এলাকার প্রাণ ছিল। এখন তা ইট-বালুতে ঢেকে গেছে, ঘাটের অস্তিত্বই হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, ২০০০-০১ সালে ঘাটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও প্রায় পাঁচ-ছয় বছর পর্যন্ত এখানে ট্রলার ভিড়ত। পরে পন্টুন সরিয়ে নেওয়ার পর ঘাট সম্পূর্ণ দখল হয়ে যায়।
বিআইডব্লিউটিএ ২৫ সেপ্টেম্বর তিন দখলদারকে নোটিশ দিয়েছিল Ñশাহজালাল ট্রেডার্সের খায়রুল আলম, মেসার্স কামরুল ট্রেডার্সের মালিক কামরুল ইসলাম ও মেসার্স তরফদার ট্রেডার্সের মালিক মীর্জা তরফদারকে। ওই নোটিশে বলা হয়Ñ দুই দিনের মধ্যে অবৈধ স্থাপনা ও মালামাল সরিয়ে ফেলতে হবে, অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু দখলদাররা তা আমলে নেননি। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও বিআইডব্লিউটিএ এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক মাসুদ পারভেজ বলেন, তিনি পূজার ছুটিতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুস্থ হয়ে কর্মস্থলে ফিরেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, দৌলতপুর লঞ্চঘাটটি ২০০৯-১০ অর্থবছর পর্যন্ত চলমান ছিল, এরপর ২০১০-১১ অর্থবছরে পন্টুন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
অন্যদিকে কেসিসি সচিব শরীফ আসিফ রহমান বলেন, দৌলতপুর বাজার থেকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত কিছু দোকান বরাদ্দপ্রাপ্ত, তবে দুয়েকটি অবৈধভাবে নির্মিত দোকান আছে, বিষয়টি দেখা হচ্ছে।
ঘাটের একাংশ ইজারা নিয়ে ব্যবসা পরিচালনাকারী বিএনপি নেতা রিয়াজ শাহেদ বলেন, বিআইডব্লিউটিএ ভুল করে তাঁকে নোটিশ দিয়েছে, অথচ আওয়ামী লীগের তিন নেতা কোনো বরাদ্দ ছাড়াই ঘাট দখল করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। চক্রটি এমনভাবে ঘাটটি ভরাট করেছে যে, এখন ঘাটের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি ঘাটে যাওয়ার রাস্তার পাশে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে ভাড়া আদায় করছেন তারা।
দৌলতপুর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী বলেন, দৌলতপুর থানায় মোট ১৯টি পূজামণ্ডপ আছে, এর মধ্যে আটটি মন্দিরের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় এই ঘাটে। প্রতিমা বিসর্জনের সময় দুই-তিন হাজার মানুষের সমাগম হয়। বালু-ইটের স্তূপ ও দখলকৃত স্থাপনার কারণে পূজা উদযাপন বড় ঝুঁকিতে পড়ে। প্রশাসন সামান্য বালুর বস্তা ফেলে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে, কিন্তু এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়।
এলাকাবাসী বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও লঞ্চঘাটটি পুনরায় চালু হয়নি। নদী পারাপারের বিকল্প ঘাটও তৈরি হয়নি। এতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছেন। তাঁরা দ্রুত অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, ঘাট পুনরুদ্ধার ও দুর্গাপূজায় নিরাপদ প্রতিমা বিসর্জনের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।