মেরামতের বদলে নতুন সড়কে আগ্রহ

তাওহীদুল ইসলাম
০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৫২
শেয়ার :
মেরামতের বদলে নতুন সড়কে আগ্রহ

দেশের বেশির ভাগ সড়ক-মহাসড়কের করুণ দশার কারণে যানবাহন সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। যাত্রীদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়। তিন ঘণ্টার পথ পার হতে লেগে যায় পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। উন্নত দেশগুলোয় নতুন সড়ক কমপক্ষে ১০ বছর টেকসই থাকে, মেরামত করতে হয় না। বাংলাদেশে নির্মাণের তিন-চার বছর, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক বছরের মধ্যে মেরামতকাজ জরুরি হয়ে পড়ে। নির্মাণকাজে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর বেশির ভাগই নিম্নমানের। আবার মেরামতের কাজও ঠিকমতো না হওয়ায় কয়েক মাসের মধ্যে সড়ক পুরনো অবস্থায় ফিরে আসে। এই ধারা চলে আসছে বহু বছর ধরে। নতুন সড়ক নির্মাণের পর তা রক্ষণাবেক্ষণে আগ্রহ কম দেখা যাচ্ছে। এর জেরে টিকছে না সড়ক। দুর্ভোগে পড়ছেন দেশের মানুষ।

যেসব সড়কে পণ্যবাহী যান ও যাত্রী চলাচল বেশি করে, সেগুলো সংস্কারে অগ্রাধিকার পাবে। এমনভাবে সড়ক সংস্কার করতে হবে, যেন তা স্থায়ী হয়। অর্থাৎ সড়কের গুরুত্ব বুঝে সে অনুপাতে বরাদ্দ দেওয়া হবে। চলতি বর্ষা শেষে বেহাল সড়ক সংস্কার করবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। মূলত তিনটি কারণে সড়ক দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলো হলো- অতিরিক্ত ভার বহনকারী যানবাহন, নকশাগত দুর্বলতা ও নিম্নমানের নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষায় সড়ক দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ ব্যয় বেশি কেন তা খতিয়ে দেখতে রিভিউ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি জানান, এই কমিটির কাজ হবে নির্মাণ ব্যয় কমানোর উপায় বের করা।

জানা গেছে, বর্ষা শেষে সংস্কার শুরু হবে। যেসব রাস্তা বৃষ্টি-বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেগুলো কংক্রিট দিয়ে সংস্কার করা হবে। অগ্রাধিকার পাবে জাতীয় মহাসড়ক। এরপর আঞ্চলিক মহাসড়ক একই পদ্ধতিতে সংস্কার করা হবে।

গ্রামীণ সড়কের দায়িত্বে রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সংস্থাটির ১ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার সড়ক পাকা। এর মধ্যে ৪৫ হাজার কিলোমিটার মেরামত করা জরুরি। এ জন্য দরকার অন্তত ২২ হাজার কোটি টাকা। পাওয়া যায় গড়ে ৩৩০০ কোটি টাকা। এ অপ্রতুল বরাদ্দে মেরামতকাজ সম্পন্ন করা দুষ্কর। এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেনের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে এলজিইডির সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ওয়াহিদুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম। এলজিইডির সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ অপ্রতুল হয়ে পড়ে বরাদ্দকৃত অর্থে।

সরকারের জাতীয় সড়ক ব্যবস্থার শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, দেশের সব উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কের একক দায়িত্ব এলজিইডির। এলজিইডির আওতাধীন গ্রামীণ সড়কের উন্নয়ন-রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও সংস্থাটির। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বিস্তৃত সড়ক নেটওয়ার্ক এলজিইডির। গ্রামীণ সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অন্যতম কারণ অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যানবাহন চলাচল। উপজেলা সড়ক ও ইউনিয়ন সড়কে ৮ দশমিক ২ টন এবং গ্রামীণ সড়কে ৫ টনের বেশি পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে এর চেয়ে অধিক ওজনের যানবাহন চলাচল করে। এ কারণে সড়ক দ্রুত নষ্ট হয়। অতিবৃষ্টি, সড়কের পাশের পুকুর বা খালের পাড় বাঁধানো না থাকা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও সড়কের ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে।

এলজিইডির মতো সওজের সড়ক মেরামতেও বরাদ্দ কম। ৩৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ মেলে। অথচ সংস্থাটির চাহিদা অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকা। গত বছর দেশের অস্থির পরিস্থিতিতে অনেক সড়ক মেরামত করা যায়নি। বরং কিছু অর্থ ফেরত গেছে। তাই দ্রুত সড়ক মেরামতে নজর দেওয়া জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে। আর নতুন সড়ক মেরামতে ব্যয় যাচাইয়ের বিষয়েও একমত প্রকৌশলীরা। তাদের মতে, পরিষেবা সংযোগ স্থানান্তরে বড় ব্যয় হচ্ছে। এ কারণে খরচ বেশি মনে হতে পারে।

এ বিষয়ে সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান আমাদের সময়কে বলেন, ‘সড়কের ব্যাপারে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করি এর সুফল মিলবে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, নদীমাতৃক বাংলাদেশে একদা নৌপথই ছিল দেশের প্রধান যোগাযোগমাধ্যম। কিন্তু এটি শ্লথগতির। ট্রেনও অতীতের গৌরব হারাতে বসেছে। এ অবস্থায় যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন অপরিহার্য। সড়কে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চলাচল কাক্সিক্ষত নয়, ভালো মানের যানবাহন অনুপযোগী সড়কে নেমে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াবে সেটাও প্রত্যাশিত নয়।

সওজের তথ্যমতে, সারাদেশে প্রায় ১ হাজার ৪৭৮ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক বর্তমানে ভাঙাচোরা। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং নিয়ম না মেনে অতিরিক্ত ভার বহনকারী যানবাহন চলাচলের কারণে সড়ক-মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সারাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত এসব সড়ক সংস্কারে প্রায় ২ হাজার ৯০৭ কোটি ২১ লাখ টাকার বিশেষ বরাদ্দ চেয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। তবে এই বিপুল অর্থ ব্যয়ে মেরামতের পর সেই সড়ক টেকসই হবে কি না তা নিয়েও সংশয় আছে।

সওজ সূত্র জানায়, সারা দেশে ২২ হাজার ৭১৯ কিলোমিটার সড়ক আছে। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক ৪ হাজার ২৯৩ কিলোমিটার এবং আঞ্চলিক মহাসড়ক ৫ হাজার ৩৯ কিলোমিটার। জেলা মহাসড়ক আছে ১৩ হাজার ৩৮৫ কিলোমিটার। ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়ক সবচেয়ে বেশি রাজশাহী অঞ্চলে; প্রায় ২২৯ কিলোমিটার। রংপুর সড়ক বিভাগে ১৯৪ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগে ১৮৬, কুমিল্লা সড়ক বিভাগে ১৬৭, ময়মনসিংহ সড়ক বিভাগে ১৫০, সিলেট সড়ক বিভাগে ১৪৮, ঢাকা সড়ক বিভাগে ১৪৩, বরিশাল সড়ক বিভাগে ১১৯, গোপালগঞ্জ সড়ক বিভাগে ৭০ এবং খুলনা সড়ক বিভাগে ৬৮ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা বেহাল।