রামেক হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম সংকট, ধার করে চলছে কাজ

জিয়াউল গনি সেলিম, রাজশাহী
০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রামেক হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম সংকট, ধার করে চলছে কাজ

রাজশাহী অঞ্চলে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছর সেখানে প্রায় ১ হাজার ২০০ সাপে কাটা রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। মারা গেছেন ৩৮ জন। শুধু রাসেলস ভাইপারের কামড়ই বেড়েছে ৪ গুণ বেশি। এদিকে হাসপাতলটিতে সংকট রয়েছে অ্যান্টিভেনমের। হাসপাতল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে ধার করে ভ্যাকসিন নিয়ে আসছে। তবে রোগীদের জন্য খোলা হচ্ছে আলাদা একটি ওয়ার্ড।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর মে মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সাধারণত সাপে কাটা রোগী পাওয়া যায়। চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ১৬৭ জন সাপে কাটা রোগী। তাঁদের মধ্যে বিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত ছিলেন ২৪৭ জন। অবিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯২০ জন। মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৮ রোগী। ২০২৪ সালে হাসপাতালটিতে ভর্তি হন ১ হাজার ৩৭০ জন সাপে কাটা রোগী। তাঁদের মধ্যে বিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত ছিলেন ৩১৪ জন। অবিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন ১ হাজার ৩৭০ জন। মৃত্যুবরণ করেন ৪০ রোগী। বিশেষ করে রাসেলস ভাইপার, কেউটে ও গোখরা সাপের কামড়েই বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। শুধু রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মারা গেছেন ১০ জন।

এদিকে গত ৮ বছরে রাসেলস ভাইপারের কামড় বেড়েছে চার গুণ। ২০১৮ সালে রামেকে হাসপাতালে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে ভর্তি হন ২১ জন। ২০১৯ ভর্তি হন ২৮ জন। ২০২০ সালে ভর্তি হন ৩৫ জন। ২০২১ সালে ভর্তি হন ৩৭ জন। ২০২২ সালে ভর্তি হন ৩১ জন। ২০২৩ সালে ভর্তি হন ৫০ জন। ২০২৪ সালে ভর্তি হন ৮৬ জন। চলতি বছরে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রামেকে হাসপাতালে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে ভর্তি হন ৫৩ জন। এই সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে গড়ে ২৩ শতাংশ।

সাপের কামড় বেড়ে যাওয়ায় চলতি মাসেই রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীর জন্য ১২ শয্যার একটি বিশেষায়িত ওয়ার্ড চালু হতে যাচ্ছে। সেখানে থাকবে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক ও নার্স এবং পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম। হাসপাতালের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সম্প্রসারিত অংশে সাপে কাটা রোগীদের জন্য ওয়ার্ড চালু করা হচ্ছে। এই ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকবেন হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবু শাহীন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তিনি জানান, এরই মধ্যে এই ওয়ার্ডের জন্য আটজন নার্স বাছাই করা হয়েছে। ওয়ার্ডের চিকিৎসক ও নার্সদের স্নেক বাইটের ন্যাশনাল গাইড অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কীভাবে রোগীদের ম্যানেজ করতে পারা যায়, সেটি তাঁরা শিখবেন। এতে করে সাপে কাটা রোগীরা আলাদা যন্ত্র পাবেন। দ্রুত তারা সুস্থ হয়ে উঠবেন।

আবু শাহীন বলেন, সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষায়িত ওয়ার্ড চালু হলে সমন্বিত চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ হবে, এতে মৃত্যুহার অনেকটা কমে আসবে। আমার এখন সাপের ধরন শনাক্ত করতে পারছি। কারণ মানুষ সাপ মেরে অথবা ছবি দেখে চিনতে পারছে। ফলে দ্রুত তাঁর চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি চিকিৎসকরা পরামর্শ দিচ্ছেনÑ রাতে অবশ্যই মশারি টানিয়ে ঘুমানো, মাঠে কাজের সময় গামবুট ব্যবহার, বাইরে চলাফেরায় টর্চলাইট ও লাঠি রাখা এবং আবর্জনা পরিষ্কার করার সময় সতর্ক থাকতে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কয়েকজন রোগী জানান, গ্রামাঞ্চলে রাতের বেলা কিংবা মাঠে কাজ করার সময় হঠাৎ সাপের কামড়ে বিপদের মুখে পড়তে হয়। চারঘাট উপজেলার কৃষক আমিরুল ইসলাম বলেন, ধানের ক্ষেতে কাজ করার সময় হঠাৎ রাসেলস ভাইপার সাপে কামড় দেয়। প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে শরীর ফুলতে শুরু করলে আমাকে হাসপাতালে আনা হয়। এখানে দ্রুত চিকিৎসা পেয়েছি, তাই বেঁচে গেছি।

বাঘা উপজেলার গৃহবধূ রহিমা খাতুন বলেন, রাতে ঘুমানোর সময় বিছানায় উঠে কেউটে সাপ কামড় দেয়। ভয় পেয়ে পরিবারের লোকজন দ্রুত হাসপাতালে আনে। এখন অনেকটা সুস্থ আছি। এর আগেও আমাদের গ্রামে দুজন সাপের কামড়ে মারা গেছেন।

কলেজশিক্ষার্থী রাজিব হোসেন জানান, বন্ধুদের সঙ্গে নদীর ধারে বসে ছিলাম। হঠাৎ পায়ে কামড় দেয় সাপ। হাসপাতালে আনার পর স্যালাইন আর ওষুধ দেওয়ার পর একটু স্বাভাবিক বোধ করছি।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহমেদ বলেন, সারা দেশে যা সাপে কাটা রোগী হয়, তার অর্ধেক অর্থাৎ ৫০ শতাংশ রোগী রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। কিন্তু এই বছর আমরা ওষুধ কোম্পানির কাছে অর্ডার দিয়েও তা পাচ্ছি না। ফলে আমাদের ভ্যাকসিন সংকট আছে। আমরা এখন এর-ওর কাছে ধার চেয়ে, ঋণ নিয়ে ভ্যাকসিন জোগাড় করছি।

শামীম আহমেদ আরও বলেন, এখানে একটি বিশেষায়িত ওয়ার্ড এই মাসের মধ্যেই চালু করব। এখানে সুস্থতার হার খুব বেশি। তবে কিছু রোগীর ওঝার কাছে যাওয়া ও হাসপাতলে আসতে দেরি হওয়ার কারণেই মৃত্যু হচ্ছে।