সার কারখানায় গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বৃদ্ধির প্রস্তাব
সার কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে এর মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) এ প্রস্তাবে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে ২৪ টাকা বাড়িয়ে ৪০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। তবে শুনানিতে অধিকাংশ বক্তা প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। নানা শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিত্ব করা এ বক্তারা বলেছেন, এতে কৃষি খাতের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। সরকারি সার কারখানাগুলোর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসির) কর্মকর্তারা বলেছেন, আগেও সার কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। অথচ বাস্তবে সরবরাহ কমানো হয়েছে।
গতকাল সোমবার রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনে দিনব্যাপী এই গণশুনানির আয়োজন করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে আগে থেকেই গণশুনানি বর্জন করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। গণশুনানি শেষে বিইআরসি একটি চিঠি জারি করেছে।
এতে বলা হয়েছে, সারে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি শেষ হয়েছে। কারও কোনো মতামত থাকলে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত লিখিত আকারে জানানো যাবে। পরবর্তী সময়ে আবেদনকারীদের প্রস্তাব, কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন, গণশুনানিতে উপস্থাপিত স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষের মতামতসহ সার্বিক বিষয়ে বিচেনা করে আইন অনুযায়ী গ্যাসের মূল্যহার সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।
দিনের শুরুতে পেট্রোবাংলার ও বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানির পক্ষ থেকে তাদের প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। আলোচনা ও বিভিন্ন প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) মিজানুর রহমান, পরিচালক (অপরেশন) প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, জেনারেল ম্যানেজার মেহেরুল ইসলাম, তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সালাহউদ্দিন, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী ফজলে আলম, সিএনজি ফিলিং স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা রেজাবুদ্দৌলা, সাংবাদিক সেরাজুল ইসলাম, লুৎফর রহমান কাকন প্রমুখ।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ শুনানি শেষে বক্তৃতায় বলেন, গ্যাসের দাম প্রশ্নে সব দিক বিবেচনা করে ভারসাম্য রক্ষা করা হবে। কৃষি খাতকে বিবেচনায় রেখে সারের দামের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, জিডিপিতে কৃষির অবদান কম হলেও খাদ্যের নিরাপত্তা এবং বিশাল কর্মসংস্থানের বিষয়টি অবশ্যই ভাবনায় রাখতে হবে। আবার এলএনজি আমদানির খরচের বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনতে হবে। এ ছাড়া শুনানির শুরুতেই তিনি বলেন, গণশুনানি একটি আইনি প্রক্রিয়া। এর ন্যায্যতা প্রমাণের দায়িত্ব প্রস্তাবকারীর। আবার কেউ ভিন্নতা প্রস্তাব করলে সেটির যৌক্তিকতা প্রমাণের দায়িত্ব ভিন্নমত পোষণকারীর। কমিশন যুক্তির যথার্থতা যাচাই করে আদেশ চূড়ান্ত করবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে বলা হয়, দাম বাড়ানো হলে বাড়তি ৭ কার্গো এলএনজি আমদানি করে সারে সরবরাহ করা হবে। ৬ মাস (অক্টোবর-মার্চ) পুরোমাত্রায় (২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হবে। অবশিষ্ট ৬ মাসের মধ্যে এপ্রিল-মে ১৬৫ মিলিয়ন হারে, জুনে ১৭৫ মিলিয়ন এবং জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৩০ মিলিয়ন হারে গ্যাস সরবরাহ দেবে।
বিসিআইসির পরিচালক (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) দেলোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, ২০২২ সালে একইভাবে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে ৪ দশমিক ৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়েছিল। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যায়নি, বরং অনেকখানি কমেছে সরবরাহ। তবে যদি পুরোমাত্রায় গ্যাস দেওয়া হয়, তা হলে ২০ লাখ টনের ওপরে সার উৎপাদন করা সম্ভব। আর ২০ লাখ টন সার উৎপাদন করা গেলে গ্যাসের ৩০ টাকা হলেও আমদানির তুলনায় কম দাম পড়বে। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম যদি ৩০ টাকা হয়, আর যদি ২০ লাখ টন উৎপাদন করতে পারি, তা হলে প্রতি কেজি সারের উৎপাদন খরচ পড়বে ৪৬ টাকার মতো। সেখানে আমদানিতে ৬১ টাকার মতো ব্যয় হচ্ছে।
বিসিআইসির পরিচালক বলেন, ট্রেড গ্যাপ (ভর্তুকি) সুরাহা না করে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে সার কারখানাগুলো তীব্র আর্থিক সংকটে পড়বে। গ্যাস বিল পরিশোধে বিলম্বসহ সারের উৎপাদন হুমকির মুখে পড়তে পারে। গ্যাসের মিশ্রিত দর ২৮ টাকার নিচে হওয়ার উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর তীব্র বিরোধিতা করা হয়। বক্তারা বলেন, এতে সারের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। আর সারের দাম বেড়ে গেলে কৃষির ওপর চাপ বাড়বে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বিসিআইসি জানিয়েছে, বর্তমানে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের উৎপাদন খরচ পড়ছে ৩৮ টাকার মতো। বিসিআইসি ডিলারের কাছে ২৫ টাকা দরে বিক্রি করে, আর ডিলার বিক্রি করেন ২৭ টাকা দরে। ট্রেড গ্যাপ (উৎপাদন ও বিক্রয়মূল্যে ঘাটতি) ১৩ টাকা ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করছে সরকার। গ্যাসের দাম বেড়ে গেলে সারের উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যাবে। সেই ট্রেড গ্যাপের (ভর্তুকি) আগে সুরাহা হওয়া দরকার।
বিসিআইসি একটি রিপোর্ট উপস্থাপনা করে দেখিয়েছে, আগের সরবরাহ বাড়নোর কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে নিয়েছে পেট্রোবাংলা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শুধু ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার কোম্পানি প্রায় পুরোমাত্রায় উৎপাদন করেছে। যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি গ্যাসের অভাবে ৩৬১ দিন পুরোপুরি বন্ধ ছিল। চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি বন্ধ ছিল ২৭৩ দিন, ঘোড়াশাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি ১৯৮ দিন বন্ধ ছিল। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি মাত্র ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ সময় উৎপাদনে ছিল। প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আগের বছরের তুলনায় গ্যাস সরবরাহ কমেছে।
ঘোড়াশাল ফার্টিলাইজার দৈনিক চাহিদা ৭২ মিলিয়ন ঘনফুট, শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের চাহিদা ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট, চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের চাহিদা ৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট, যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের চাহিদা ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট, আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের চাহিদা ৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত আশুগঞ্জ সার কারখানা অনেক পুরনো হওয়ায় গ্যাস খরচ অনেক বেশি, যে কারণে কারখানাটি বন্ধ রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া বিদেশি কোম্পানির মালিকানাধীন কাফকো সার কারখানায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট। কাফকোকে চুক্তির আওতায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হয়। আর তাদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক দরে ডলারে সার কিনে নেয় বাংলাদেশ। সম্প্রতি কোম্পানিটির সঙ্গে ৩০ টাকা দরে চুক্তির নবায়ন করা হয়েছে।
বিসিআইসি দাবি করেছে, বছরে ৩০ থেকে ৩২ লাখ টন ইউরিয়া সার জোগান দিতে হয়। গ্যাসের অভাবে আমদানি করে ১৬ থেকে ২১ লাখ টন জোগান দিতে হয়। গ্যাস অভাবে বন্ধ থাকায় কারখানাগুলো কুলিং টাওয়ার, ইলেকট্রিক্যাল বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। যার কারণে অপরেশনাল খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মনিরুজ্জামান বলেন, সারের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে কোনো প্রস্তাব নেই। সে কারণে কৃষকের ওপর কোনো চাপ পড়বে না। তবে সারের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে সেই ঘাটতির পূরণের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়া দরকার।